জরুরি অবস্থার একাল-সেকাল — প্রতিরোধ জরুরি

একজন খ্যাতনামা সমাজতত্ত্ববিদ একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, ভারতের সংবিধানে প্রদত্ত “মৌলিক অধিকারগুলো” (ফান্ডামেন্টাল রাইটস) বস্তুত “হ্যাঁ-সূচক” (পজিটিভ) নয়, বরং বলা ভালো “নেগেটিভ” (না-সূচক)। কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগতে পারে ভেবে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সংবিধানের “মুখবন্ধে” (প্রিঅ্যাম্বল) সাম্যের অধিকার (রাইট টু ইকোয়ালিটি)-র কথা বলা হয়েছে তা কিভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে, প্রতিষ্ঠা না পেলে কাকে দায়ী করা হবে, তার শাস্তির কি ব্যবস্থা হবে, তার কোনো উল্লেখ নেই। এটা কি মৌলিক অধিকার? নাকি প্রসাধনী অধিকার? একই কথা প্রযোজ্য “রাইটস টু ফ্রিডম” (স্বাধীনতার অধিকার)-এ উল্লেখিত ৮টি অধিকার সম্পর্কেও। সংবিধানের ১৪ থেকে ৩০ এবং ৩২ নং ধারায় উল্লেখিত মৌলিক অধিকারগুলোও একইভাবে না-সূচক। সংবিধানের ১৯নং ধারায় উল্লেখিত “সমাবেশিত হওয়ার স্বাধীনতা”, ঐ ধারারই ১৯(৩) ধারায় নিয়ন্ত্রণ বা কেড়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এমনকি “রাইট টু লাইভ ও লাইভলিহুড” (বেঁচে থাকা ও জীবনধারণের) মতো চূড়ান্ত বুনিয়াদী ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার রয়েছে এই “সংবিধানে” ! সাধারণ সময়ে অনালোচিত বা কম চর্চিত এই প্রশ্নগুলোই মূর্ত হয়ে উঠেছিল “অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা”র দিনগুলোতে। “জরুরি অবস্থা”র দিনগুলো নিয়ে তদন্তের জন্য গঠিত “শাহ কমিশনে” এসব প্রশ্নই ছিল মূল বিবেচ্য।

ভারতে তিন তিন বার জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল – ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় – এক্সটার্নাল এমারজেন্সি (বৈদেশিক জরুরি অবস্থা)। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ও এক্সটার্নাল জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৫২নং ধারায় “অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা”, অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা এবং রাজ্য স্তরে জরুরি অবস্থা (ধারা ৩৫৬, যা রাষ্ট্রপতির শাসন বলে পরিচিত) জারি করার সুযোগ করে দেওয়া অাছে।

যে “নীরব প্রতিবিপ্লব” ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাতে সংঘটিত হল, তার সূত্রপাত মোটেই নীরব ছিল না। ৬০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকেই যে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে দেশ জর্জরিত হচ্ছিল তা থেকে বেরিয়ে অাসার জন্য শাসকশ্রেণী ও তাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি কংগ্রেস দল কোনো গণতান্ত্রিক পথ বেছে নিতে রাজি ছিল না। কংগ্রেস দলের শ্রেণীচরিত্র তাকে স্বৈরাচারী পথেই যেতে বাধ্য করল। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তার মিশ্র অর্থনীতি বিপর্যস্ত। খাদ্য সংকট চরমে। টাকার অবমূল্যায়ন করেও বৈদেশিক বাণিজ্যে কোনো লক্ষ্যণীয় উন্নতি নেই। শাসক দলের অভ্যন্তরে চরম গোষ্ঠীকোন্দল, পরিণতিতে বড় ধরনের বিভাজন। ৫০-এর দশকে কংগ্রেস দলের রীতি ও কাঠামোয় যতটুকু লিবারেল ডেমোক্রেসির অস্তিত্ব ছিল, ৬০-এর দশকের শেষপর্বে সেটুকুও উধাও হয়ে গেল। রাজ্যে রাজ্যে জনবিচ্ছিন্ন বশংবদ অাঞ্চলিক নেতার হাতে ক্ষমতার রাশ অার কেন্দ্রীয় স্তরে তথাকথিত হাইকম্যান্ডের নামে এক দুষ্টচক্র ক্ষমতাকে করায়ত্ত করল। সংকট সমাধানে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার বা ভূমি বণ্টনের গণতান্ত্রিক পথে হাঁটার বদলে শুরু হল পুঁজির কেন্দ্রীভবন-ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মনভোলানো শ্লোগানের অাড়ালে ব্যাঙ্কগুলোকে করা হল কর্পোরেটের সেবাদাস। কর্পোরেট বসদের ঐ সমস্ত ‘জাতীয়’ ব্যাঙ্কের মাথায় বসানো হল। নন পারফর্মিং এ্যাসেট-এর যে রমরমা অাজ চোখের সামনে চলে এসেছে, তার সূত্রপাত ঐ সময়েই। ভূমিসংস্কার, অভ্যন্তরীণ মেধা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খাদ্য সংকটের সমাধান করার বদলে বিদেশী পুঁজি-প্রযুক্তি, বীজ-সার-কীটনাশক কাজে লাগিয়ে তথাকথিত সবুজ বিপ্লব অামদানি খাদ্য সংকটের সাময়িক কিছু সুরাহা করলেও চিরস্থায়ী সর্বনাশের পথ তৈরি করল। দেশের মধ্যে নেমে এল স্বৈরাচারী হামলা। অামাদের এরাজ্যে কৃষকের বিদ্রোহ ও বিস্ফোরণকে স্তব্ধ করার জন্য চলল রাষ্ট্রের হামলা। বিপ্লবী অভ্যুত্থান মুখোমুখি হল হিংস্র প্রতিবিপ্লবের। শাসক দলের অভ্যন্তরে যেমন ভাঙন ঘটলো, ক্ষমতা কুক্ষিগত হল একটি দুষ্ট চক্রের হাতে, বাম অান্দোলনেও এল বিভ্রান্তি ও বিকৃতি। ‘ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ সমাজতন্ত্রের পথে এক ধাপ অগ্রগতি’ এই অাজগুবি শ্লোগান তুলে বাম অান্দোলনের একটা অংশ সরাসরি স্বৈরাচারের পক্ষ নিল। মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী অন্য একটি অংশ পরিস্থিতি যাচাইয়ের নামে নিষ্ক্রিয় হল। স্বৈরাচারকে মুখোমুখি প্রতিহত করার বদলে বুর্জোয়াদের মধ্যে বন্ধু খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিস্থিতির এই সুযোগে স্বৈরাচার তার অাগ্রাসী হামলা নামিয়ে দিল। ১৯৭৫-এর ২৫ জুন মধ্যরাতে রবার-স্ট্যাম্প রাষ্ট্রপতি সংবিধানকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে গণতন্ত্র হত্যার কালা ফতোয়ায় স্বাক্ষর করলেন। অথচ সংবিধানের ৩৫২ ধারায় পরিষ্কার লেখা অাছে যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর অাগ্রাসন, অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিদ্রোহ (অার্মড রিবেলিয়ন)-এর পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। ১৯৭৫ সালে উপরোক্ত কোনো পরিস্থিতিই বিরাজ করছিল না। ২১ মাস দীর্ঘ (২৫ জুন, ১৯৭৫ থেকে ২১ মার্চ ১৯৭৭) এই জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ি ও স্বৈরাচার নিয়ে তদন্ত করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত শাহ কমিশনের তিনটি রিপোর্টের কোথাও নেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা কবে, কখন, কোথায়, কোন অধিবেশনে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার এক দুষ্টচক্র (ইন্দিরা-সিদ্ধার্থ-প্রণব মুখার্জী), সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতার কেন্দ্র সঞ্জয় গান্ধী, দেবকান্ত বরুয়া (কংগ্রেসের সভাপতি), রজনী প্যাটেল (মহারাষ্ট্র প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি) ইত্যাদিরা দেশজুড়ে সন্ত্রাস-উচ্ছেদ (তুর্কমান গেটে বস্তি উচ্ছেদ স্মরণ করুন), নাসবন্দি, গ্রেপ্তার (মিসা, ভারত রক্ষা অাইন) হত্যা-গণহত্যার ধ্বংসলীলা চালাল।

কিন্তু স্বৈরাচার শেষ কথা বলে না। ২১ মাস সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতার চক্র যে ক্ষমতার অপব্যবহার করল, তা গণরায়ে পরাজিত হল ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে। অথচ কি অশ্চর্য! এই স্বৈরাচারের বিচারের দাবি দিনের পর দিন অবহেলিত থাকার পর ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে দুটি অাদালত গঠন করা হল। কোনো রকমের সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রণব মুখার্জীর কথা অাজও মনে পড়ে, ‘‘মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়েছি, তাই কোনো কথা বলব না”। বিচারপর্বে প্রশ্ন উঠল, “বেঁচে থাকা ও জীবনধারণে ”র মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে কি শাস্তি প্রযোজ্য? তৎকালীন এ্যাটর্নি জেনারেল জানাচ্ছেন, ‘‘সরকার যদি অাদালতের নির্দেশ কার্যকরী না করে, তবে কী করণীয় অাছে”। সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো এভাবেই বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে।

ঘোষিত ‘জরুরি অবস্থা’র ইতিহাস কি বর্তমানের জন্য কোনো শিক্ষা বহন করে? অতীত যদি বর্তমানের সেবা করে ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশিকায় সাহায্য করে, তবে নিশ্চিত বলতে হবে স্বৈরাচার ভারতে নতুন রূপে ও নতুন চরিত্রে অাবির্ভূত হচ্ছে। নয়া অর্থনীতি ও শিল্পনীতির পৃষ্ঠভূমে জন্ম নিচ্ছে কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ। জল-জমি-জঙ্গল-প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুঠ চলছে। যে অাদিবাসী-ভূমিজ জনগণ এই লুঠের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করছেন, তারা হচ্ছেন দেশের ‘এক নম্বর শত্রু’। বস্তার থেকে গাড়চিরোলি, জঙ্গলমহল থেকে গিরিডি-লোহারদাগা – সর্বত্রই এক ছবি। শত্রুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু জনগণ। সামন্ততান্ত্রিক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী নারীরা হচ্ছেন ‘বেহায়া’। বেয়নেট ও বুলডোজারের মাধ্যমে জমিগ্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কৃষকরা হচ্ছেন ‘উন্নয়ন-বিরোধী’। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছাত্র-যুব-বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের দালালরা ব্রিটিশদের তৈরি ১৮৬০-এর ‘দেশদ্রোহ অাইন’কে দেশপ্রেমের কষ্ঠিপাথর করতে চায়। সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধ্বজাধারীরা রাষ্ট্রকে ‘কঠোর’ করতে অাফস্পা, ইউএপিএ কাজে লাগায়। ভারতের মহামান্য অাদালতের বিচারপতিরা এখন শীতঘুমে চলে গেছেন। এরাই সংবিধানের দৃঢ় রক্ষক, অভিভাবকও বটে! এরাই সিঙ্গুরের জমিগ্রাসের মামলা বছরের পর বছর দেরাজবন্দি করে রাখে, নন্দীগ্রাম-ছোট অাঙারিয়া গণহত্যায় অভিযুক্ত অপরাধীরা জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাপম গণহত্যায় অভিযুক্তরা মন্ত্রীত্বে অাসীন থাকে। গুজরাত গণহত্যার নায়ক ও খলনায়ক স্বচ্ছ ভারত ও হিন্দু রাষ্ট্রের ছবি অাঁকে। মন কি বাত – এ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের শ্লোগান তুলে দাদরির মহম্মদ এখলাককে খুন করে।

জরুরি অবস্থার অতীত ও বর্তমান একসূত্রে বাঁধা। প্রতিরোধ তাই জরুরি ও অবশ্য কর্তব্য। অাসুন অামরা বামপন্থীরা একযোগে রুখে দাঁড়াই। মরীচিকার পেছনে না ছুটে রুক্ষ প্রান্তরে লড়াইয়ের লালঝাণ্ডা নিয়ে পথ চলি। জনগণ পথে নেমেছে, ছাত্র-যুবরা জোট বেঁধেছে। শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী সৈনিকদের এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।

Back-to-previous-article
Top