নীতীশ বনাম নীতীশ ও টপারগেট দুর্নীতি : বিহারে ছাত্রদের উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের অাত্মপ্রতিষ্ঠার সময় সমুপস্থিত

পাটনার নামকরা কলেজ অফ অার্টস এ্যান্ড ক্রাফটসের উজ্জ্বল ছাত্র নীতীশ কুমারের অাত্মহত্যার চেষ্টা রোহিত ভেমুলা অাখ্যানের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে। হায়দ্রাবাদে যা ঘটেছে এবং পাটনায় যা ঘটে চলেছে এই দুইয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। রোহিতের মতো নীতীশও এক দলিত ছাত্র যাকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। অাবার রোহিতের মতো নীতীশও তার সহপাঠীদের ন্যায়বিচার লাভের জন্য লড়াইয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। অার্টস কলেজের ছাত্রদের মিথ্যা অভিযোগে শুধু সাসপেন্ড করাই হয়নি, গ্রেপ্তারও করা হয়েছে, নীতীশ ছাত্রদের ওপর এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। তবে এ দুইয়ের মধ্যে পরিহাসময় ফারাকটা হল – হায়দ্রাবাদে রোহিত ও তার সহপাঠীদের এমন একটা গাঁটছড়ার হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল যার শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এবিভিপি কর্মীদের ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দিয়ে এবং বিস্তৃত হয়েছিল কেন্দ্রের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পর্যন্ত; অার পাটনায় এই গাঁটছড়া নীতীশ কুমার সরকারকে ধরেই সচল হয়েছে, যে সরকার নিজেকে সামাজিক ন্যায় ও সুশাসনের একনিষ্ঠ রূপকার বলে দাবি করে এবং মূলত সামাজিক ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের প্রচারকে ধরেই বিজেপির বিরুদ্ধে বিপুল জয় হাসিল করেছিল।

পাটনার অার্টস এ্যান্ড ক্রাফটসে নীতীশ ও তার বন্ধুরা কলেজের প্রিন্সিপাল চন্দ্রভূষণ শ্রীবাস্তবের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে; এই প্রিন্সিপাল ২০১২-র অক্টোবর থেকে ‘অস্থায়ী’ পরিবর্ত হিসাবে তার সময়কালে ন্যক্কারজনক জাতপাতবাদী এবং যৌন অাসক্তিময় অাচরণের জন্য ছাত্রদের মধ্যে প্রবল কুখ্যাতি অর্জন করেছেন; এই কুখ্যাতি অর্জনের অারও কারণ হল স্বৈরাচারী অাচরণের মধ্যে দিয়ে এমন এক কলেজ পরিচালনা করা যা ‘অংশগ্রহণমূলক এবং সৃষ্টিশীল পরিমণ্ডল’-এর কথা বলে। প্রিন্সিপালের অপসারণের এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে ১৩০ জনেরও বেশি ছাত্রছাত্রীর স্বাক্ষর করা একটি অাবেদনপত্র জমা পড়েছে উপাচার্য এবং তার সাথে মুখ্যমন্ত্রী, নারী কমিশনের চেয়ারপার্সন, এসসি/এসটি কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশনের কাছে। কলেজের জঘন্য পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য যে সমস্ত ছাত্রকে অন্যায়ভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছে, সেই অাদেশ প্রত্যাহারের জন্য ছাত্ররা এপ্রিলের শেষদিক থেকে অান্দোলন করে অাসছে। ছাত্ররা জোরের সাথে বলছে — তাদের সমস্ত অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি তাঁর পদে থেকে যেতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্যসচিবের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার জন্য।

পুনের এফটিঅাইঅাই-এর চেয়ারম্যান পদে গজেন্দ্র চৌহানের নিয়োগ এবং ভারতের সেন্সর বোর্ডের প্রাধন হিসাবে পহলাজ নিহালনির নিয়োগ সারা দেশের সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে প্রবল ধাক্কা হয়েই দেখা দেয়। এই নিয়োগগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুধু গৈরিক নাশকতার চক্রান্ত থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার গণতান্ত্রিক তাগিদ থেকেই উৎসারিত হয়নি, এই নিয়োগগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি প্রকাশিত ধৃষ্টতাময় অবজ্ঞা সৃষ্ট প্রতিঘাত ঐ প্রতিবাদের পিছনে অারও বড় কারণ হয়ে উঠেছে। শাসক দলের প্রতি অানুগত্য বা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই যদি সৃজনশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হয়ে ওঠে, তবে তা সৃজনী স্বাধীনতা এবং উৎকর্ষের মৃত্যুঘণ্টাই বাজিয়ে দেয়। পাটনা অার্টস কলেজের ব্যাপারটাও কম মর্মঘাতী নয়। প্রিন্সিপাল যখন অাতঙ্ক ও স্বৈরাচারের পরিমণ্ডলে লজ্জাকর জাতপাতবাদী অারচণ এবং যৌন অাসক্তির প্রকাশ ঘটিয়ে একটি সৃজনধর্মী প্রতিষ্ঠানকে শাসন করেন, তখন তা সৃজনশীল মানুষের শালীনতাবোধের প্রতি অাঘাত এবং ছাত্রদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর অাক্রমণ হয়েই দেখা দেয়। এবং এই ধরনের এক ব্যক্তি যদি ছাত্রদের বারবার অভিযোগ সত্ত্বেও উচ্চতর কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতা ও মদত পেয়ে চলেন তবে তা ক্ষমতার ঔদ্ধত্য ও তার অপব্যবহারের একটি প্রশ্নহীন দৃষ্টান্তই হয়ে ওঠে, গণতন্ত্রপ্রেমী প্রতিটি মানুষকেই যার বিরোধিতা করতে হবে।

অার্টস কলেজ উপাখ্যান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তা বিহারের শিক্ষা ব্যবস্থায় গভীরতর ও ক্রমবর্ধমান পচনের প্রতীক হয়েই দেখা দিচ্ছে। ‘সর্বোচ্চ স্থানাধিকারীদের কেলেঙ্কারি’ অার একটি অালোড়নময় লজ্জাকর দৃষ্টান্ত। মোদীর তথাকথিত ‘সমগ্র রাষ্ট্র বিজ্ঞানে’ ডিগ্রি হাসির রোল তুলতে পারে, কিন্তু এবারের বোর্ডের বারো ক্লাসের পরীক্ষায় অার্টস বিভাগে প্রথম স্থানাধিকারী যখন বলে যে, রাষ্ট্র বিজ্ঞান থেকে সে ‘রন্ধন নৈপুণ্য’ শিখেছে তখন তাতে বিহারে লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখ কপালে উঠেছিল। বিহার স্কুল পরীক্ষা বোর্ডের প্রধান লালকেশ্বর প্রসাদ সিং — যিনি নীতীশ কুমার অনুগত বলেই সুবিদিত – তদন্তের মুখোমুখি হওয়াকে এড়াতে পদত্যাগ করে ফেরার হয়েছেন। তার স্ত্রী, যিনি নালন্দা জেলার হিলসা কেন্দ্রের প্রাক্তন জেডিইউ বিধায়ক, নির্বাচনী হলফনামায় এমন ডিগ্রিধারী বলে নিজেকে দাবি করেছেন যা সন্দেহজনক। টপার দুর্নীতির চাঁই বাচ্চা রাইকে অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং জেডিইউ, অারজেডি এবং বিজেপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার দহরম মহরম নিয়ে বিহারের সংবাদপত্রগুলোতে শিরোনাম হচ্ছে। ইনি তাঁর বাবার নামে নামকরণ করা বৈশালীর বিষুণরাই কলেড চালান এবং জালি উচ্চ স্থানাধিকারীদের জন্ম দেন। যথাযথভাবে তদন্ত হলে টপার দুর্নীতি বিহারে মধ্যপ্রদেশের ভ্যাপম দুর্নীতির সমতুল্য হয়ে দেখা দিতে পারে। ২০০৫ সালে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর নীতীশ কুমার মুচকুন্দ দুবে কমিশন গঠন করেন, যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। কিন্তু এখন প্রকাশিত ঘটনা দেখাচ্ছে যে, ঐ কমিটির সুপারিশ করা অভিন্ন বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে যেমন বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তেমনই উচ্চস্তরের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশাসনিক মদতের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রণালীবদ্ধ বিপর্যয় চলতে থাকে। এই অবক্ষয়ের পিছনে কারণকে খুঁজে বার করতে এবং দোষীদের শাস্তি দিতে অবিলম্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।

বিহার ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী ছাত্র অান্দোলনের এক ধাত্রীভূমি হয়ে থেকেছে। নীতীশ কুমার ও লালু প্রসাদের মতো ছাত্র নেতাদের রাজনৈতিক উত্থান ১৯৭৪-এর ছাত্র অান্দোলন থেকেই হয়েছিল। ১৯৭০-এর দশক ও পরবর্তী প্রজন্মের ৠাডিক্যাল ছাত্র অান্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। চন্দ্রশেখর থেকে শুরু করে অাজকের প্রজন্মের কানহাইয়া কুমার, অাশুতোষ ও চিন্টু, বিহারের এই ছাত্র অান্দোলনের কর্মীরা জেএনইউ এবং দেশের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনে প্রগতিবাদী ছাত্র অালোচনাধারাকে গড়ে তুলতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছেন। অাজ যখন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অান্দোলনের কর্মীদের সন্ত্রাসবাদী বলে ছাপ মেরে সমস্ত ধরনের শাস্তি ও নিগ্রহের শিকার করে তোলা হচ্ছে, তখন বিহারে প্রগতিশীল ছাত্র অান্দোলনকে পুনরায় অাত্মপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, নীতীশ এবং পাটনা অার্টস কলেজ ও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য লড়াকু ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে এবং শিক্ষা ও কাজ এই দুই ক্ষেত্রে বিহারের যুবকদের সঙ্গে যে তামাশা ও বিশ্বাসঘাতকতা চলছে তার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।

Back-to-previous-article
Top