“বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত” : পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলী শাসনের মোকাবিলা ও বামপন্থী পুনর্জাগরণের চ্যালেঞ্জ

পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি ও মা-মাটি-মানুষের অবিরাম ঢক্কা-নিনাদের পাঁচটি বছর পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ অাবার বিধানসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায়। পাঁচ বছর অাগে পরিবর্তনের যে ডাক মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল তার পেছনে ছিল প্রায় জগদ্দল পাথরের মতো অচলায়তনে পরিণত দীর্ঘ ৩৪ বছরের সিপিএম শাসন। সাড়ে তিন দশকের নিরবচ্ছিন্নতার ক্লান্তি নয়, বাংলার ব্যাপক মানুষের কাছে, এমনকি বামফ্রন্ট সমর্থক ভোটদাতাদের এক বড় অংশের কাছেও, যা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল তা হল বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে বাম শাসনের ঔদ্ধত্য, উন্নাসিকতা ও নির্লজ্জ কর্পোরেট বন্দনা। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় – সিপিএম রাজত্বের অবসানের বার্তা দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়ে গেলেও সি পি এম সে লেখা পড়তে চায়নি। ২০০৬-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয়লাভের এক মাসের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে সিঙ্গুর থেকে যে পটপরিবর্তনের সূচনা হয় তা যেন অনিবার্যভাবেই ২০১১-র নির্বাচনে বামফ্রন্ট সরকারের শোচনীয় পরাজয়ের সুনিশ্চিত ঠিকানায় পৌঁছে যায়।

অাজ পাঁচ বছর পরে, সরকার পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি পূরণ ছাড়া তৃণমূল সরকারের ‘সাফল্যের’ ভাঁড়ারে তেমন কিছু নেই। সরকারী খয়রাতি বণ্টনের সীমিত কর্মসূচী ও কিছু সাংকেতিক পারিবারিক সহায়তা প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে একদিকে তুমুল প্রচার অভিযান, অন্যদিকে চা-বাগানে অনাহার মৃত্যুর মিছিল, রাজ্যজুড়ে ভেঙে পড়া দুর্নীতিগ্রস্ত রেশন ব্যবস্থা, সরকারী ঔদাসীন্যে ও সংকটে নাজেহাল কৃষকসমাজ। একদিকে সারদা কেলেঙ্কারীতে ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ ও যুব-সমাজ, অন্যদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের নির্লজ্জ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ। একদিকে রাজ্যজুড়ে নারী নির্যাতন, যৌন হিংসা ও হয়রানির ক্রমবর্ধমান তালিকা, অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রীর চোখে এসবই হয় সাজানো ঘটনা, নয় ছোটখাট ব্যাপার। সিপিএম অামলে দলতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে অাজ রাজ্যজুড়ে মমতা শাসনে নেমে এসেছে তৃণমূলী অাক্রমণ ও পুলিশী নির্যাতন। একদা অান্দোলনের নেত্রী মুখ্যমন্ত্রীর অাসনে অধিষ্ঠিত হতেই গণতান্ত্রিক অান্দোলন ও মিছিল-সমাবেশের ওপর চেপে বসেছে অজস্র নিষেধাজ্ঞা।

বিগত পাঁচ বছরের এই অভিজ্ঞতা অাজ স্বাভাবিকভাবেই বাংলার জনগণকে অাবার একবার মোহভঙ্গ ও বিক্ষোভের পথে ঠেলে দিয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে মমতা ব্যানার্জী দ্বারস্থ হয়েছেন দেশী-বিদেশী কর্পোরেট মহলের। বৃহৎ পুঁজিকে খুশি করতে ও স্বাগত জানাতে বইয়ে দিয়েছেন প্রতিশ্রুতির বন্যা – মনে হচ্ছে গোটা রাজ্য সরকার অাজ কর্পোরেট লুটেরাদের স্বাগত জানাতে নিজেকে কার্পেট হিসাবে বিছিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনীতে যেখানে জিন্দল গোষ্ঠীকে দশ বছর অাগে ১০ মিলিয়ন টন ইস্পাত ও ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে ৪০০০ একর জমি দেওয়া হয়েছিল (পরবর্তীতে জিন্দল গোষ্ঠী কৃষকদের কাছ থেকে অারও ৩০০ একর জমি কিনে নেয়), অাজ ২০১৬ সালের গোড়ায় এসে জিন্দল গোষ্ঠী সেখানে ১৩৪ একর জমিতে ২৪ লক্ষ টন সিমেন্ট উৎপাদনের কথা বলছে। সব ঠিকমতো এগোলে উৎপাদন শুরু হবে ২০১৮ সালে, স্থায়ী কাজ পাবেন মাত্র ২০০ জন শ্রমিক। মমতা ব্যানার্জীর প্রচারতন্ত্রের কাছে এটাই পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে শিল্পবিপ্লবের মহান সূচনা।

যে গণসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে মমতা ব্যানার্জী ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই সেই সমর্থনে অাজ ভাটা পড়েছে। সরকারের ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং তৃণমূলী সন্ত্রাস ও হিংসা মানুষের মনে অাবার মোহমুক্তি ঘটিয়ে বিক্ষোভ জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে সেই বিক্ষোভের প্রতিফলন ঘটছে না কেন ? ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় বিজেপির এক অভূতপূর্ব উত্থান চোখে পড়েছিল, – অাসন সংখ্যার নিরিখে না হলেও ভোট শতাংশের হিসেবে। কিন্তু বিজেপির সেই শক্তিবৃদ্ধি যতটা না তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিক্ষয় ঘটিয়েছিল তার চেয়ে বেশি বোধকরি ভাগ বসিয়েছিল কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের ভোটে। পরবর্তী পর্যায়ে দেশজুড়ে মোদী ঢেউ স্তিমিত হয়ে অাসার সাথে সাথে পশ্চিমবাংলাতেও বিজেপির অাবার ভোট কমেছে, কিন্তু তৃণমূলের ভোটে সেরকম কোনো ক্ষয় সাধারণভাবে এখনও চোখে পড়েনি।

এ থেকে একটা কথা সহজেই বেরিয়ে অাসে। সি পি এম-এর যে গণভিত্তি বিক্ষুব্ধ-বীতশ্রদ্ধ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে সরে গিয়েছিল তা এখনও বামফ্রন্টের দিকে ফিরে অাসেনি। পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার রাজনৈতিক প্যাটার্নের সবচেয়ে বড় পার্থক্যটা এখানেই। কেরালায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাধারণভাবে সরকার পরিবর্তন হয়। কংগ্রেস ও সিপিএমের মূল গণভিত্তি সেখানে মোটামুটিভাবে স্থির এবং দু’তিন শতাংশ ভোটের পার্থক্যে সাধারণভাবে হার-জিত নির্ধারিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী বামপন্থী শাসনের অবসান লগ্নে সিপিএমের গণভিত্তি ও রাজনৈতিক প্রভাবে খুব স্পষ্ট বহুমাত্রিক ক্ষয় চোখে পড়ে যার মূলে ছিল – (১) কৃষক ও গ্রামীণ গরিব জনগণের ব্যাপক বিক্ষোভ, (২) মুসলিম সম্প্রদায় ও দলিত-অাদিবাসী সমাজে গভীর বঞ্চনাবোধ, (৩) বুদ্ধিজীবীবর্গ ও শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে পরিবর্তনের তীব্র তাগিদ, (৪) দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতার অাকর্ষণে ও ক্ষমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী চক্রের শিবির পরিবর্তন। বিগত পাঁচ বছরে এই বুনিয়াদী প্রেক্ষাপটে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। গণতন্ত্রের ওপর তৃণমূলী অাক্রমণের ফলে নাগরিক সমাজের একাংশ অবশ্যই বর্তমান জমানার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, কিন্তু বুনিয়াদী জনগণের অাস্থা ফিরে পেতে বা জনগণের স্বার্থরক্ষা ও অধিকার অাদায়ের জন্য স্থানীয় স্তরে কোনো জোরালো অান্দোলন গড়ে তুলতে সিপিএম সাধারণভাবে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি।

এর বিপরীতে যে ছবিটা মাঝে-মাঝেই ফুটে উঠেছে তা হল সিপিএম বা বামফ্রন্ট শিবিরে বড় মাত্রায় হতাশা, বিভ্রান্তি ও শিবির পরিবর্তন। গত পাঁচ বছরে পঞ্চায়েত ও এমনকি বিধানসভা স্তরে নির্বাচিত বামফ্রন্ট প্রতিনিধিদের তৃণমূলে যোগদানের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। তৃণমূলী সন্ত্রাস অবশ্যই এর পেছনে একটা উল্লেখযোগ্য কারণ, কিন্তু সুবিধাবাদী রাজনীতির চাপ ও লোভ বোধকরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অারও বড় কারণ। এককথায় বলা যায় প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দীর্ঘ তিন দশক ধরে নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে সরকার-কেন্দ্রিক যুক্ত মোর্চার যে বামফ্রন্ট নামক মডেলটি গড়ে উঠেছিল, ক্ষমতা থেকে অপসারণের সাথে সাথে সেই মডেলটিই বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাড়ে তিন দশক পরে বিরোধী পক্ষের রাজনীতিতে নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জের জবাবে সিপিএম নেতৃত্ব ‘শুদ্ধিকরণ’ ও বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বললেও কার্যত সিপিএম নেতৃত্বের এক বড় অংশ এরাজ্যে অাজও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের পর্যায়েই অাটকে অাছেন – গত পাঁচ বা দশ বছরের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার কোনো ছাপই তাঁদের মধ্যে নেই।

শোনা গিয়েছিল ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের পর বিশাখাপত্তনম কংগ্রেসে সিপিএম তার রাজনৈতিক কৌশলগত লাইনের সমীক্ষা করবে। শেষ পর্যন্ত সমীক্ষার নামে যা পাওয়া গেল তা অাবার সেই পরিচিত মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী সমাহার। একদিকে বিজেপি, কংগ্রেস এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত অাঞ্চলিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিবৃদ্ধি ও বাম-গণতান্ত্রিক ঐক্যের ওপর গুরুত্ব অারোপ, অন্যদিকে রাজ্যে রাজ্যে উপযুক্ত কৌশল এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে নমনীয় কৌশল গ্রহণের নামে সুবিধাবাদী জোট গঠনের জন্য খোলা দরজা। পশ্চিমবাংলায় এই রাজনৈতিক কৌশলগত লাইন অনুযায়ী রাজ্য নেতৃত্বের এক বড় অংশই বেশ কিছুদিন ধরে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠনের ওকালতি করে চলেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে ২০১১ সালের নির্বাচনী পরাজয়ের জন্য এই নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারকেই দায়ী করে থাকেন। তাঁদের মতে এই সমর্থন প্রত্যাহারের ফলেই রাজ্যে সিপিএম কংগ্রেসকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের দিকে ঠেলে দেয় এবং এই জোটের ফলেই নাকি ২০১১ সালে সিপিএম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এই সুবিধাবাদী মনোগত বিশ্লেষণকে চোখে অাঙুল দিয়ে ভুল প্রমাণিত করে দেয়। কংগ্রেস অালাদাভাবে নির্বাচনে লড়া সত্ত্বেও তৃণমূলের ফলাফলে কোনো অবনতি ঘটেনি বা সিপিএমের ভোট কমে যাওয়াও তাতে অাটকে যায়নি। অাসনগত ফলাফলের দিক থেকে অবশ্য একথা সত্য রায়গঞ্জ ও মুর্শিদাবাদ অাসনে সিপিএমের জয়লাভ ভোট ভাগাভাগির ফলেই সম্ভব হতে পেরেছিল। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট ভাঙার পর এবার সিপিএমের এই নেতারা কংগ্রেসকে শুধু তৃণমূল থেকে অালাদা রাখা নয়, বরং সিপিএম ও কংগ্রেসের জোট গড়ে তুলতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। রাজ্য সম্পাদক ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি কংগ্রেসের কাছে অাহ্বান জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নেতারাও ‘প্লেনামের পরে রাজ্য কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে’ এ কথা বলে এই মরিয়া প্রচেষ্টাকে জিইয়ে রেখেছেন। কেরালা ও ত্রিপুরার বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সখ্যতার ফলে পশ্চিমবাংলায় শেষ পর্যন্ত সিপিএম-কংগ্রেস নির্বাচনী জোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলেও সিপিএম নেতৃত্বের এই মরিয়া প্রচেষ্টা এক চূড়ান্ত অপমানজনক নজির হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

সম্প্রতি কলকাতায় হয়ে গেল সিপিএমের সর্বভারতীয় সাংগঠনিক প্লেনাম। প্রায় চার দশক অাগে এক অন্য পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিপিমের একদা বহু চর্চিত সালকিয়া প্লেনাম। সেটা ১৯৭৮ সাল। জরুরি অবস্থার অবসানে সাতাত্তরের নির্বাচনে অাশাতীতভাবে সিপিএম তখন রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। কেন্দ্রে দেশের প্রথম অকংগ্রেসী সরকার। ১৯৭৮-এ জলন্ধর কংগ্রেসে সিপিএম কংগ্রেস বিরোধী বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্যের লাইন নিয়ে এল, তার পাশাপাশি শালকিয়া প্লেনামে গৃহীত হল পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হিন্দি বলয়ে সিপিএমের দ্রুত সম্প্রসারণের প্রস্তাব। এবারের প্লেনামের প্রেক্ষাপট ছিল অনেকটা অন্যরকম। রাজ্যে সিপিএম ক্ষমতা থেকে অবসারিত। হিন্দি বলয়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্য অাজও অপূর্ণ। পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের কাছে সাড়ে তিন দশক পর অাবার নতুন করে বিরোধীপক্ষের শক্তি হিসেবে, অান্দোলনের পার্টি হিসেবে উঠে দাঁড়াবার চ্যালেঞ্জ। এমন অবস্থায় প্লেনামের ভেতরে সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে যাই অালোচনা হোক না কেন, প্লেনামকে ঘিরে যে পরিবেশ তৈরি হল বা প্লেনাম থেকে যে বার্তা বেরিয়ে এল তাতে ছেয়ে থাকল পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় ফিরে অাসার সুখস্বপ্ন নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার তাগিদ। অার প্লেনামের অব্যবহিত পরেই সিঙ্গুর থেকে শালবনী পদযাত্রার মতো কর্মসূচীর মাধ্যমে সিপিএম যেন জানান দিতে চাইল ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের শোচনীয় পরাজয় অাসলে বাংলার মানুষেরই মস্ত বড় ভুল এবং অাবার সিপিএমকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনে জনগণকে সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

বেকারত্ব অবশ্যই পশ্চিমবাংলার এক মস্ত বড় সমস্যা, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন যুবসমাজের কাছে এক অাশু গুরুত্বের প্রশ্ন। মমতা ব্যানার্জীর পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রীত্বকালে ব্যর্থতা ও বিশ্বাসঘাতকতার নজিরও কম নয়। কিন্তু সিঙ্গুর ও শালবনীকে প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়ে সিপিএম কী বার্তা দিতে চাইল ? সিপিএম অামলে শিল্পের নামে কর্পোরেট হাতে জমি তুলে দেওয়ার সবচেয়ে বড় দুই উদাহরণ সিঙ্গুর ও শালবনী — সিঙ্গুরে এক হাজার একর বহু ফসলি জমি ও শালবনীতে সাড়ে চার হাজার একর বনভূমি এবং অাদিবাসী ও অন্য কৃষকদের হাতে থাকা কৃষিজমি যথাক্রমে টাটা ও জিন্দল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। সিঙ্গুর অান্দোলনের পর্যায়ে টাটা সিঙ্গুর ছেড়ে নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটে পাড়ি দেন, কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই অাজ টাটা সেই ন্যানো গাড়ির প্রকল্পকেই এক ভুল উদ্যোগ বলে কবুল করে নিয়েছেন। সিঙ্গুরের অব্যবহৃত জমি ফেরতের মামলা অাজ সুপ্রীম কোর্টে অাটকা পড়ে অাছে। শালবনীতে কিছু জমি কৃষককে ফেরত দেওয়ার পরেও অাজও চার হাজার একর জমির ‘সেজ’ প্রকল্প অলস মরুভূমির মতো পড়ে অাছে। বহু প্রতিশ্রুত ইস্পাত ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের অাজও কোনো সম্ভাবনা নেই, শিল্পের নামে অবশেষে এক সিমেন্ট কারখানা যাতে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে এক হাজারেরও কম।

সিপিএমের চোখে সিঙ্গুর ও শালবনী যদি অাজও উন্নয়ন ও শিল্পায়নের প্রতীক হয়ে থাকে তাহলে বলতেই হবে যে সিপিএম নেতারা দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে বসে রয়েছেন। সেজের নামে হাজার হাজার একর জমি কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়ে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের ঢাক পেটানোর কারসাজি অাজ মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের মতো তুলনামূলকভাবে শিল্পোন্নত রাজ্যগুলোতেও ধরা পড়ে গেছে। কৃষিসংকট, ক্রমবর্ধমান বেকারী, দারিদ্র ও ব্যাপক বৈষম্যের রূঢ় অর্থনৈতিক বাস্তবের ছবিটা অাজ প্রায় সর্বত্রই প্রকট হয়ে উঠছে। ‘অামরা ক্ষমতায় এলেই সিঙ্গুর-শালবনীর শুষ্ক মরুদ্যানে শিল্পের ফুল ফুটিয়ে দেব’ এমন দাবি মানুষের কাছে শুধু বিশ্বাসযোগ্য প্রতিপন্ন হবে না তাই নয়, সেই প্রতিশ্রুত শিল্পের মধ্যে সাধারণ মানুষ অাজ তার অভিজ্ঞতা থেকে কোনো উন্নয়ন বা কর্মসংস্থানের অাশা দেখতে পান না। অার তাই বোধ হয় সিঙ্গুরের জনসভায় সুপ্রীম কোর্ট থেকে জমি ফেরতের মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলে শালবনী পৌঁছে সূর্যকান্ত মিশ্রকে বলতে হল শিল্পের নামে বহু-ফসলি কৃষিজমি দখল করাটা ঠিক নয়।

সিপিএম নেতৃত্ব অাজও বুঝতে পারছেন না যে সিঙ্গুর শব্দটা শুনলে পশ্চিমবাংলার সাধারণ মানুষের চোখে টাটার না হওয়া কারখানার স্বপ্ন ভেসে ওঠে না, বরং জোর করে লাঠি-গুলি চালিয়ে কৃষকের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার ও তার বিরুদ্ধে কৃষক জনগণ, বিশেষ করে কৃষক রমনীদের সাহসী প্রতিরোধের স্মৃতিই অাবার নতুন করে জ‍েগে ওঠে। সেই স্মৃতিতে সিপিএমের ভাবমূর্তি কোনো কৃষকদরদী জনস্বার্থপ্রেমী উন্নয়নকামী বামপন্থী দল হিসেবে ধরা পড়ে না, সেখানে কর্পোরেট স্বার্থে কৃষকের জমি-জীবিকা-জীবন কেড়ে নেওয়ার নোংরা বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষতই অাবার দগদগে হয়ে ওঠে।

সিঙ্গুর-শালবনীর ভ্রান্ত পথেরও একটা পূর্ব ইতিহাস অাছে যেটা অাজ অাবার স্মরণ করা দরকার। কেন্দ্রের ২০০৫ সালের সেজ অাইনের অাগেই পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকার ২০০৩ সালেই সেজ অাইন প্রণয়ন করেছিল। তারও এক দশক অাগে ১৯৯৪ সালে জারি হয়েছিল কেন্দ্রের নয়া শিল্পনীতির অাদলে রাজ্যের নতুন শিল্পনীতি। জনমুখী জনস্বার্থবাহী উন্নয়নের বিকল্প পথের চিন্তাভাবনা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাদ দিয়ে সিপিএম নেতৃত্ব তখন থেকেই নেমে পড়ে শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন পার্টি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্পোরেট পুঁজিকে অাকৃষ্ট করার ও ছাড় দেওয়ার প্রতিযোগিতায়। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যখন ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ স্লোগানের সাথে সাথে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হচ্ছে, নতুন করে ক্ষমতায় ফিরে কংগ্রেস যখন ‘অাম-অাদমীর’ কথা বলে কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অাইন, অরণ্য অধিকার অাইন প্রবর্তনের পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় বুদ্ধদেববাবুর বামফ্রন্ট সরকার তখনই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনীর পথে শিপ্লায়ন ও উন্নয়নের কর্পোরেট পথে জোর কদমে পা বাড়াচ্ছে। অাজ দশ বছর পরে সে ভুলের এত বড় মাশুল দিয়েও সিপিএম নেতৃত্বের কোনো বোধদয় দেখছি না।

জমি-জীবিকা, খাদ্য ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের ময়দানেই পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৭৭-এ জরুরি অবস্থার শেষে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই জনগণ বামপন্থীদের ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা ও পঞ্চায়েতীরাজ প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর মাধ্যমে খেটেখাওয়া মানুষের বড় অংশের সমর্থনে সিপিএম অর্জন করেছিল এক বিশাল গণভিত্তি। কিন্তু ইতিহাসের পরিহাসে ২০১১ সাল অাসতে অাসতে সেই জমি, কৃষি, কৃষকের অধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নেই গণভিত্তি ও ভাবমূর্তিকে খুইয়ে সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হতে হল। অাজ এই মূল প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে অাবার সেই সিঙ্গুর-শালবনীর নামে অহংকার দিখেয়ে জনগণের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দে‍ওয়া সম্ভব, কিন্তু হারিয়ে যা‍ওয়া গণভিত্তি ও ভাবমূর্তিকে ফিরে পাওয়ার এটা কখনোই পথ হতে পারে না।

বামফ্রন্টের পুরনো মডেলে ধাক্কা লাগার পরে সিপিএম সর্বভারতীয় স্তরে সিপিঅাই(এম এল) ও এসইউসিঅাই সহ ছটি বামপন্থী দলের ইস্যুভিত্তিক যৌথ অভিযানের পথে অগ্রসর হয়। এই বৃহত্তর অান্দোলনমুখী ঐক্য দেশজুড়ে বামপন্থী কর্মী ও জনগণের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া জাগায়। সম্প্রতি বিহারের নির্বাচনে সিপিঅাই ও সিপিএম জনতা দল (ইউ)-রাষ্ট্রীয় জনতা দল-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে সিপিঅাই(এমএল)-এর সাথে যুক্ত হয়ে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বামপন্থী ব্লক হিসেবে অংশগ্রহণ করে। দেশজুড়ে বাম শিবিরে এরও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের বর্তমান ভূমিকা বৃহত্তর বামপন্থী ঐক্য ও বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে চলেছে। বামপন্থী গণসংগঠনগুলোর যুক্তমঞ্চের নামে সিপিএম যেভাবে একের পর এক দলীয় কর্মসূচী চাপিয়ে যাচ্ছে – প্রথমে সিপিএম প্লেনাম উপলক্ষে ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার কর্মসূচী এবং পরবর্তীতে সিঙ্গুর থেকে শালবনী পদযাত্রা – সেই অাধিপত্যবাদী সংকীর্ণতা অতীতে বামফ্রন্ট মডেলকে যেমন বিকৃত করেছে, ভবিষ্যতের বৃহত্তর বামপন্থী ঐক্যের সম্ভাবনাকেও একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার তাগিদ নয়, সাধারণ মানুষের জমি-জীবিকা-কাজ, খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সম্মান – এক কথায় গণতন্ত্র ও সমাজ পরিবর্তনের জরুরি কর্মসূচীর ওপর ভিত্তি করে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও কর্পোরেট পুঁজি ও সাম্প্রদায়িক স্বৈরাচারী শক্তির সমস্ত অাগ্রাসনকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করে উন্নয়নের বিকল্প পথেই পশ্চিমবাংলায় বামপন্থার পুনর্জাগরণ ঘটবে। ধৈর্য, সাহস ও বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সাথে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের এ পথেই এগোতে হবে, ঐক্যবদ্ধ করতে হবে ব্যাপক সংগ্রামী বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে। দেশজুড়ে অাজ যেমন মোদি সরকারের জনবিরোধী ও গণতন্ত্র-বিরোধী পদক্ষেপ এবং অারএসএস-বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন, বিগত পাঁচ বছরে অামরা একইভাবে বাংলার মানুষকে প্রতিবাদে-অান্দোলনে মুখর হয়ে উঠতে দেখেছি। কামদুনি কাণ্ডের প্রতিবাদে ফেটে পড়া তীব্র গণরোষ বা কলকাতার বুকে ছাত্রসমাজের “হোক কলরব” অান্দোলন, কৃষকের অাত্মহত্যা ও চা-বাগানে অনাহার মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিদ্যুতের মারাত্মক মাশুল বৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ – বাংলার মানুষ বারবার পথে নেমেছেন। এই গণঅান্দোলনের ময়দানেই বামপন্থা বাংলার বুকে ঐতিহাসিকভাবে বেড়ে উঠেছে, অাজও সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে বাংলার সংগ্রামী চেতনা অাবার গর্জে উঠবে, নতুন প্রাণশক্তিতে ও প্রতিবাদী স্পর্ধায় উজ্জীবিত হয়ে উঠবে শেকলভাঙার বামপন্থা। বাংলা অাবার বলবে, “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত”।

Back-to-previous-article
Top