২২ এপ্রিলের অাহ্বান (২০১৬)

যুব-ছাত্রদের উত্থানকে শক্তিশালী করুন!

গণ-প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলুন!

গণতন্ত্র বাঁচান, ভারত বাঁচান!


অাগামী ২২ এপ্রিল হল সিপিঅাই(এমএল) প্রতিষ্ঠার ৪৭তম বার্ষিকী এবং ২৫ মে ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান ৫০ বছরে পদার্পণ করবে। এই অভ্যুত্থান ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমগ্র নতুন প্রজন্মের এক নতুন সমাবেশ কেন্দ্র হিসাবে সিপিঅাই(এমএল) প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। অামরা যখন অামাদের উজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি, তা করি বর্তমানের সংগ্রামী ময়দানে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে এবং অামাদের নজরে থাকে সামনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলি।

কেন্দ্রে ভারতের প্রথম বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের প্রধান হিসাবে মোদী অাসার পর এটা খুবই স্পষ্ট যে সংঘ বাহিনী কর্পোরেট ভজনাকারী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সমগ্র এজেন্ডাকে ধারাবাহিকভাবে রূপায়ন করে চলেছে। দেশের প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ থেকে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পর্যন্ত, ইতিহাস-সংস্কৃতি ও জ্ঞানের জগৎ থেকে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকারের সাংবিধানিক ক্ষেত্র এবং প্রজাতন্ত্রের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিভূমি পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংঘ বাহিনী সম্মিলিত অাক্রমণ নামিয়েছে। তারা ভিন্ন মতাবলম্বীদের অপরাধী বানাতে ও তাদের দমন করতে নির্লজ্জের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মূল মূল পদগুলিতে বাছাই করা ব্যক্তিদের বসাতে রাষ্ট্রক্ষমতাকে পুরোপুরি ব্যবহার করছে এবং নিজেদের গুণ্ডা ও দুর্বৃত্তদের পুরো নিরাপত্তা দিয়ে রক্ষা করছে।

সংঘ বাহিনীর এই অাক্রমণকে মোকাবিলা করার সময় অামাদের অবশ্যই পরিস্থিতির যে উজ্জ্বল দিকগুলিতে নজর রাখতে হবে তা হল – জনগণ সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক অাক্রমণকে সাফল্যের সঙ্গে উন্মোচিত করছেন, চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন এবং এমনকি কখনও কখনও এই অাক্রমণকে পিছু হঠতে বাধ্য করছেন। ২০১৫ সালে কৃষক সংগঠনগুলির ও বেশিরভাগ রাজনৈতিক পার্টিগুলির জোরালো বিরোধিতায় সরকারকে জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। এ বছরের বাজেটে সরকারকে শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। গত বছর গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি ও মহম্মদ অাখলকের হত্যাকাণ্ডে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা যে প্রতিবাদ শুরু করেন তা অাজ শক্তিশালী যুব-ছাত্র উত্থানের মধ্যে পূর্ণতা পাচ্ছে।

ছাত্রদের এই উত্থান বা ভারতের বেড়ে ওঠা যুব-বসন্তের রয়েছে সেই সক্ষমতা যা কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক জমানার ফ্যাসিবাদী অাক্রমণকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ও তাকে প্রতিহত করতে পারে। এ হল দীর্ঘস্থায়ী ধরনের এক উত্থান, যার ঝলক অামরা গত কয়েক বছর ধরে সময় অন্তর প্রত্যক্ষ করছি। দিল্লীতে এক তরুণীকে ধর্ষণ ও হত্যার ভয়াবহ ঘটনার বিরুদ্ধে অামরা এই উত্থান ফেটে পড়তে দেখেছি, যা পিতৃতন্ত্রের বাঁধন থেকে ভারতের মহিলাদের স্বাধীনতার অাওয়াজ তুলে সারা দেশেই অনুরণিত হয়। স্বপ্নদর্শী ও গবেষক রোহিত ভেমুলার মর্মান্তিক অাত্মহত্যার ঘটনায় অামরা অাবার হায়দ্রাবাদে এই উত্থান ফেটে পড়তে দেখেছি এবং তা সামাজিক বৈষম্যের কলঙ্ক ও ভারতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গৈরিকীকরণের ক্রমবর্ধমান নাগপাশের বিরুদ্ধে সারা দেশের হৃদয়ে নাড়া দেয়। তারপর অাবার অামরা দিল্লীর জেএনইউ-তে গৈরিক বাহিনীর দ্বারা ডাইনি খোঁজা ও পুলিশী দমনপীড়নের ঘটনায় এই উত্থান ফেটে পড়তে দেখি এবং তা অাজকের ভারতে গণতন্ত্র ও “অাজাদি”র দাবিতে পরিণত হয়।

অাজ অামরা প্রত্যক্ষ করছি জাগ্রত যুবদের বলিষ্ঠ অাত্মঘোষণা, সরকার বদলের পরেও যারা সোচ্চার। ২০১৪ সালের গোড়ায় দিল্লীতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে অাপ ও অরবিন্দ কেজরীওয়াল ক্ষমতায় অাসার পরে অনেকে ভেবেছিলেন যে যুবদের অভ্যুত্থান নতুন রাজনৈতিক গন্তব্যস্থল খুঁজে পেয়েছে। ২০১৪-র মে মাসে অারও অনেকে দাবি করেছিলেন যে পরিবর্তনের জন্য যুব-ভারতের অন্বেষণের নির্ধারক উত্তর হিসাবেই মোদীর অাবির্ভাব। কিন্তু মোদী-উত্তর পরিস্থিতিতে ছাত্রদের জাগরণ স্পষ্ট করে দেয় যে ভারতের যুবদের পরিবর্তনের অাকাঙ্খা নিবৃত হয়নি, বরং তা ক্রমবর্ধমান এবং তাদের রয়েছে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তির চক্রান্ত ও হুকুমদারিকে মোকাবিলা করার সাহস, শক্তি ও সক্ষমতা। পরিবর্তনের জন্য ছাত্রদের অাকাঙ্খায় নিহিত রয়েছে ভগৎ সিং ও অাম্বেদকরের উত্তরাধিকার এবং অামরা যদি দিল্লী বা এলাহাবাদ, গোয়ালিয়র বা মুজফ্ফরপুরে অারএসএস-বিজেপি-এবিভিপি গুণ্ডাদের দ্বারা রাজনৈতিক কর্মী এবং বিদ্বজ্জনদের ওপর মরিয়া অাক্রমণকে দেখি তাহলে এটা খুবই স্পষ্ট যে ভগৎ সিং ও অাম্বেদকরের এই উত্তরাধিকার ও ছাত্রদের অভিষ্ট ঐ লক্ষ্যে সংঘ বাহিনী কি ভয়ঙ্করভাবে ভীত।

অার এটা বোঝাও কষ্টকর নয় যে কেন ভগৎ সিং ও অাম্বেদকর সম্পর্কে এবং বাস্তব অান্দোলনে এই দুই উত্তরাধিকারের অারও বেশি কাছাকাছি অাসার সম্ভাবনায় কেন সংঘ বাহিনী এত বেশি ভীত। বিজেপি ভালভাবেই জানে যে ভারতের স্বাধীনতা অান্দোলনের উজ্জ্বল ইতিহাসে তাদের কোনো শিকড় নেই। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে তাদের মতাদর্শগত পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন সাভারকার, যিনি ইংরেজ শাসকদের কাছে নিজের জন্য মার্জনা ভিক্ষা এবং হিন্দু-রাষ্ট্রের প্রবক্তা হওয়ার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। অারএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা মুসোলিনী ও হিটলারের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এবং রক্তপাতময় দেশ-ভাগের মধ্যে যখন ঔপনিবেশিক শাসকদের শেষপর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয় তখন অারএসএস-হিন্দু মহাসভার অবদান হল গান্ধীকে হত্যা করা। এর ফলে সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন কংগ্রেস নেতা সর্দার প্যাটেল, যাঁকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে অাদবানি ও মোদী খুবই অাগ্রহী। এই কলঙ্কজনক ও লজ্জাজনক ইতিহাসের বিপরীতে ভারতের বিপ্লবী যুবরা ভগৎ সিং-এর অাত্মত্যাগ ও বীক্ষা থেকে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অাপসহীন লড়াইয়ের উত্তরাধিকার থেকে এবং সমস্ত ধরনের দাসত্ব ও বন্ধন থেকে মুক্তির পক্ষে তাঁর পরিপূর্ণ অঙ্গীকার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে চলছেন।

অারএসএস-এর কাছে ভগৎ সিং-এর মতো অাম্বেদকরও হলেন ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য, কেননা তিনি হিন্দুরাষ্ট্র সম্পর্কে অারএসএস-এর বীক্ষার মনুবাদী ভিত্তিতে অাঘাত করেছিলেন এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি হিসাবে সংবিধানের মধ্যে স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা সহ জাতপাত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার রণধ্বনি দিয়ে জাতপাত ব্যবস্থাকে পুনর্জ্জীবিত করার অারএসএস-এর স্বপ্নকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংখ্যালঘু তোষণ বলে কুৎসা করে এবং জাতপাতের বিভাজন ছাড়িয়ে হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের অাহ্বান জানিয়ে বিজেপি তার জাতপাত ব্যবস্থার সপক্ষে মনোভাবকে অাড়াল করতে কঠোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের থেকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীকে ফেরি করে বিজেপি দলিত ও ওবিসিদের প্রতি তার বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবকে তুলে ধরতে চাইছে। সযত্নে তৈরি এই ছদ্মবেশকে অাম্বেদকর কেবলমাত্র ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেই দেননি , ন্যায়ের জন্য সমস্ত ধরনের সংগ্রামগুলির মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণাও দিয়েছেন। এই কারণেই মরিয়া সংঘ বাহিনী অাম্বেদকর-পেরিয়ার অধ্যয়ন চক্রকে ভেঙ্গে দে‍ওয়ার জন্য অাইঅাইটি, মাদ্রাজ কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে। কেবলমাত্র দেশজোড়া প্রতিবাদ গড়ে ওঠার পরেই এই অধ্যয়ন চক্র অাবার চালু হয়। মুজফ্ফরনগরে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সংঘ বাহিনী হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলা ও তার কমরেডদের এই বলে অভিযুক্ত করে যে তারা দেশবিরোধী ও জাতপাতগত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত।

ছাত্র-যুবদের বর্তমান জাগরণকে কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর রণাঙ্গনে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, মতাদর্শগত জবরদস্তি ও ফ্যাসিবাদী হামলাকে মোকাবিলা করতে হবে এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াকু জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কালে এটাই ছিল ভগৎ সিং-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, এটাই ছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে বিপ্লবী ছাত্রদের প্রতি চারু মজুমদারের অাহ্বান, যা গ্রামীণ গরিবদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে ঐতিহাসিক ছাত্র উত্থানকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এটাই হল অাম্বেদকরের বাণীর মর্মবস্তু – “শিক্ষিত কর, সংগঠিত কর, অালোড়ন তোল”। নকশালবাড়ির “বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ”-এর বিপ্লবী মর্মবস্তু দিয়ে বর্তমান “যুব বসন্ত”কে সিক্ত ও জারিত করে অাসুন অামরা অাম্বেদকরের এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে চলি এবং ফ্যাসিবাদী বিপদকে পরাজিত করে পূর্ণ স্বাধীনতা ও পূর্ণ গণতন্ত্রের নতুন ভারত গড়ার পথে এগিয়ে চলি।

সিপিঅাই(এমএল) লিবারেশন

কেন্দ্রীয় কমিটি

Back-to-previous-article
Top