২০১৫ সালের সংকল্প দিবসে কেন্দ্রীয় কমিটির অাহ্বান : প্রতিটি মুহূর্ত অাঁকড়ে ধরুন, পার্টির বিস্তার ঘটান ও কমিউনিস্ট অান্দোলনকে শক্তিশালী করুন

(১৭ বছর অাগে ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর লক্ষ্ণৌতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীন অামরা কমরেড বিনোদ মিশ্রকে হারাই। তার পর থেকে প্রত্যেক বছর পার্টি এই দিনটিকে সংকল্প দিবস হিসাবে পালন করে অাসছে। এই দিন থেকে পার্টির সদস্যপদ নবীকরণ অভিযান শুরু হয় এবং পার্টি বিপ্লবী লক্ষ্য সম্পাদন করতে নতুন করে সংকল্প গ্রহণ করে)।

১৭ বছর অাগে যখন অামরা কমরেড বিনোদ মিশ্রকে হারাই অামাদের দেশ তখন প্রথম এন ডি এ সরকারের এবং কেন্দ্রে বিজেপি পরিচালিত সরকারের অবস্থান জনিত রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত তাৎপর্যকে সবেমাত্র মোকাবিলা করা শুরু করে। কমরেড বিনোদ মিশ্রের নেতৃত্বে সমগ্র পার্টি বিজেপির গৈরিকীকরণ এজেন্ডার বিরুদ্ধে এক দৃঢ় পাল্টা মতাদর্শগত অভিযান ও শক্তিশালী ”গৈরিক হঠাও, দেশ বাঁচাও” অভিযান শুরু করে। প্রথম এন ডি এ সরকার বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু তা ১৯৯৯ সালে অারও বড় জোট নিয়ে ফিরে অাসে। অবশ্য ২০০২ সালে গুজরাট গণহত্যাকাণ্ডের পর দেশ প্রথম সুযোগেই বিপর্যয়কর এন ডি এ জমানা হঠাতে সমর্থ হয়।

অাজ ১৭ বছর পর, অামরা অার এক বিজেপি পরিচালিত সরকারের দ্বারা চালানো এক সম্পূর্ণরূপে ও পুরো মাত্রায় কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক অাক্রমণকে দেখতে পাচ্ছি এবং এবারে তারা ক্ষমতায় ফিরেছে অারও বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। কিন্তু অামরা এটাও বলতে পারি, কমরেড বিনোদ মিশ্র দূরদৃষ্টিতে শক্তিশালী বিপ্লবী-গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ সংগ্রামের যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন তা অামরা এখন প্রত্যক্ষ করছি।

২০১৪ সাল যদি ভারতীয় জনগণের কাছে ধাক্কা খাওয়ার বছর হয়ে থাকে, যে বছর নরেন্দ্র মোদী তুমুল বক্তৃতাবাজির ওপর ভর করে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসে পরিকল্পিতভাবে বিপর্যয়কর গৈরিক এজেন্ডাকে তার সামগ্রিক পরিসরে প্রয়োগ করতে শুরু করেন, তবে ২০১৫ সাল ভারতীয় জনগণের প্রত্যাঘাতের বছর হিসাবে দেখা দিয়েছে।

ফেব্রুয়ারী মাসে দিল্লীতে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাওয়া এবং নভেম্বরে বিহারে ভরাডুবি হওয়া, মাঝের এই সময়টায় প্রতিটি ফ্রন্টেই দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। কৃষক সংগঠনগুলো এবং সাধারণ জনগণের বিরোধিতার মুখে জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ বারবার জারি করার পরও মোদী সরকারকে এই বিষয়ে পিছু হঠতে হয়। অসংগঠিত এবং ঠিকা শ্রমিকদের ব্যাপক অংশ সহ ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দ্বারা সংগঠিত ২ সেপ্টেম্বরের বিশাল ধর্মঘট শ্রম অাইনগুলোকে বানচাল করা এবং শিল্পক্ষেত্রে/কর্মস্থানে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করার মোদী সরকারের প্রচেষ্টাকে পরাস্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ের সংকেত দেয়।
চেন্নাইয়ের অাই অাই টি-তে অামবেদকর-পেরিয়ার পাঠচক্রের পুনর্বহালের জন্য সফল লড়াই, এফ টি অাই অাই-তে ধর্মঘট অার এখন অকুপাই ইউ জি সি অান্দোলন – এসবই শহরাঞ্চলের যুবকদের মধ্যে মোদী হাওয়ার অতিকথাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। অার দেশের প্রথিতযশা লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বিজ্ঞানীরা পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর যে অভিযান শুরু করেছেন তা বুদ্ধিজীবীদের সমবেত অাত্মঘোষণার এক সুউচ্চ মাত্রাকে দেখিয়ে দেয়, তাঁরা যথার্থই ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী চরিত্র এবং গণতান্ত্রিক বিবেকের প্রতিনিধি হিসাবে জনগণের বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেছেন।
বিহার নির্বাচন ছিল সি পি অাই (এম এল) ও অন্যান্য বাম শক্তির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক লড়াই। জনগণের সংগ্রামের নেতৃত্বকারী কেন্দ্র ও বাম রাজনীতির স্তম্ভ স্বরূপ সি পি অাই (এম এল)-এর দৃঢ় ভূমিকা এক ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ব্লক হিসাবে এই গুরুত্বপূর্ণ লড়াই লড়তে বামেদের এক জায়গায় নিয়ে অাসতে সহায়তা করে। সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে অামাদের এই লড়াই লড়তে হয়েছিল। বিধানসভায় একনাগাড়ে ২০ বছর ধরে উপস্থিতির পর পার্টি ২০১০ সালে কোনো অাসনেই জয়ী হতে পারেনি। প্রচার মাধ্যম এবং বাইরের রাজনৈতিক দুনিয়া অামাদের পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল। বিহারে পার্টি কিন্তু সফলভাবে তার সমগ্র শক্তিকে সমাবেশিত করে ২০১৫-র লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়।

২০১০-এর ধাক্কার পর পার্টি জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ককে শক্তিশালী করা এবং পার্টি সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর ওপর নতুন করে জোর দেয়। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বিহারে পার্টির ফলাফলে অবশ্য কোনো উন্নতি ঘটে না এবং এই প্রথমবারের মতো বিহারে কোনো লোকসভা অাসনেই অামরা ১ লক্ষ ভোট লাভ করতে পারিনি। পার্টি সংগঠন এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে, পার্টি এক ব্যাপক অার্থ-সামাজিক সমীক্ষা শুরু করে, স্থানীয় স্তরে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক অান্দোলন গড়ে তোলে এবং নীচেরতলায় পার্টি নেটওয়ার্কের বিস্তার ঘটাতে ও তাকে নিপুণ করে তুলতে অান্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়।
এর ফল এখন অামরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। বিহারের চূড়ান্ত দ্বিমেরু-বিভাজিত নির্বাচনে পার্টি তার ভিত্তিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে, প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অাসনে তার ফলের উন্নতি ঘটাতে এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে তিনটি অাসনে জয়ী হতে পেরেছে। পার্টি ১৬টি অাসনে ১০০০০-এরও বেশি ভোট লাভে সক্ষম হয়েছে, ভোজপুর এবং সিওয়ানে অাবারও ১ লক্ষের গণ্ডি পার হতে পেরেছে।

বিহার নির্বাচন পার্টিকে বিহারের প্রধান বামশক্তি হিসাবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশে পার্টির সম্মিলিত ভিত্তি সমগ্র হিন্দিবলয়ে জনগণের সংগ্রাম ও বাম রাজনীতির কেন্দ্র হিসাবে অামাদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করে তুলতে সুনিশ্চিতভাবেই সহায়তা করবে। সহায়তা করবে মোদী রাজের কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক অাক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারার চলমান প্রতিবাদ ও অান্দোলনে হস্তক্ষেপ করতে।

অার এস এস-এর এজেন্ডাকে তার সমগ্র পরিসরে নামানো এবং এরই সঙ্গে চরম ঔদ্ধত্যের সাথে বিদেশী পুঁজি ও কর্পোরেট শক্তির তোষণ এবং পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রণনীতির অধীনস্থ হওয়াটা ফ্যাসিবাদের শঙ্কাকে ক্রমেই বাস্তব বিপদ রূপে প্রতিপন্ন করেছে। তবে পরিস্থিতি যেন অামাদের মধ্যে অাতঙ্ক প্রবণতার জন্ম না দেয় এবং অামরা যেন পরাজয়বাদী ধ্যানধারণা ও কৌশলের ফাঁদে পা না দিই। সুবিশাল এবং ব্যাপক বিস্তৃত প্রতিবাদগুলো সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, জনগণ বিপদ সম্পর্কে সজাগ অাছেন এবং তাঁরা বিজেপিকে দেশ কব্জা করতে ও ধ্বংস করতে দেবেন না। ফ্যাসিবাদী বিপদের মোকাবিলায় অামাদের প্রতিটি গণতান্ত্রিক পথকে কাজে লাগিয়ে অামাদের কণ্ঠস্বরকে সোচ্চার করে তুলতে হবে ও প্রতিরোধকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে এবং প্রতিটি ইতিবাচক উদ্যোগ ও সংগ্রামের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সহযোগিতা করতে হবে।

বিজেপি যদি কংগ্রেসের ক্ষয়ের সুবিধাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগিয়ে থাকে, অাপ-এর মতো একেবারে নতুন এক শক্তি যদি এখন দিল্লীতে শাসন চালাতে এবং পাঞ্জাবে তার উপস্থিতিকে ঘোষণা করতে সমর্থ হয়ে থাকে, তবে কমিউনিস্টদের কাছে চ্যালেঞ্জটা সর্বাগ্রে হল শ্রেণী সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে — মতাদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে — এক শক্তিশালী পুনরুজ্জীবনকে মূর্ত করে তোলা। এবং তা করতে হলে অামাদের পরাজয়বাদী উদারনৈতিক চিন্তাধারার মোকাবিলা করতে হবে। যে চিন্তাধারার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই এবং যা ফ্যাসিবাদী বিপদের বিরুদ্ধে লড়াইকে স্থিতাবস্থার দেউলিয়া সমর্থনেই পর্যবসিত করতে চায়।

এরই সাথে অামাদের পার্টি সংগঠনের বিস্তার ঘটানো এবং বর্তমান সন্ধিক্ষণে তার ভূমিকাকে শক্তিশালী করার চ্যালেঞ্জকেও ”সুনির্দিষ্টরূপে” অায়ত্ত করতে হবে। রাঁচি কংগ্রেস এবং লক্ষ্ণৌ কর্মশালা যথাযথ কর্মনীতিগত কাঠামো এবং মূল সাংগঠনিক কর্তব্যকর্ম ও লক্ষ্যমাত্রাকে সূত্রবদ্ধ করেছে। পার্টিকে এখন প্রতিটি ফ্রন্টে শক্তিশালী অগ্রগতি ঘটিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে। অামাদের স্বপ্নদ্রষ্টা নেতার সপ্তদশ মৃত্যুবার্ষিকীতে অাসুন, অামরা সি পি অাই (এম এল)-কে ভারতের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে তুলতে এবং কমিউনিস্ট অান্দোলনকে জাতীয় স্তরে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি করে তোলার কমরেড বিনোদ মিশ্রের স্বপ্নের বাস্তবায়নে নিজেদের পুনরায় উৎসর্গ করি।

Back-to-previous-article
Top