গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা সম্পর্কে রায়-এ সাম্প্রদায়িক হিংসায় অাক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্ত করা হল

২০০২ সালে গুজরাটে গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যায় এসঅাইটি-র বিশেষ অাদালতের সাম্প্রতিক রায়টি হল বিচারের এক বড় প্রহসন। এই রায় কেবলমাত্র গণহত্যার মূল মাথাগুলোকে বেকসুর খালাসই করেনি, গণহত্যার চক্রান্তকারীদের ছাড় দিয়ে অাক্রান্তদের দিক থেকে প্ররোচনা প্রদানকে দায়ী করা হয়েছে। ২০০২ সালে গুরজাটে হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড হল গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা। প্রকাশ্য দিবালোকে গুলবার্গ সোসাইটিতে অাগুন লাগানো হয়, ৬৯ জনকে খুন করা হয়। প্রাক্তন সাংসদ ইসান জাফরি ছিলেন অাক্রমণের লক্ষ্য। তাঁর হাত দুটি কেটে উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়, তারপর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। জাফরির কয়েক শো প্রতিবেশী তাঁর কাছে অাশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা ধরে জাফরি মরিয়াভাবে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে যান। কিন্তু এ সমস্ত ফোনে কিছুই লাভ হয় না এবং পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা গুলবার্গ সোসাইটিতে এলেও খুনে দাঙ্গাকারীদের হঠিয়ে দিতে কোনো কিছুই করেনি।

সোসাইটির বাইরে কয়েক ঘণ্টা ধরে সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা যে জড়ো হয় সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রাথমিক সাক্ষ্যকে এই রায়ে উপেক্ষা করা হয়। পুলিশ কর্তারা যে ঘটনাস্থলে যায়, দাঙ্গাকারীদের দেখতে পায়, তা সত্ত্বেও দাঙ্গাকারীদের হঠিয়ে দিতে বাহিনীকে ডাকেনি — এই অবিসংবাদী তথ্যকেও এই রায়ে অগ্রাহ্য করা হয়। বিপরীতে এই রায়ে ইসান জাফরি যে গুলি ছুঁড়েছে সে সম্পর্কে ‘ইচ্ছাকৃত স্মৃতিবিলোপের’ অভিযোগে প্রত্যক্ষদর্শীদের নিন্দা জানানো হয়। রায়ে বলা হয় যে উপস্থিত উচ্ছৃঙ্খল লোকেরা কেবল গাড়িই পোড়াতে চেয়েছিল এবং জাফরির গুলি চালনার পরই কেবলমাত্র এই লোকেরা খুন করতে শুরু করে। এ হল এক হতবুদ্ধিকর জঘন্য রায়।

একই দিনে গুলবার্গ সোসাইটির কাছেই নারোদা পাটিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীরা মুসলিমদের হত্যা করে। সমস্ত গুজরাট জুড়েই বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের হত্যা করা হয়। স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা মুসলিমদেরই হত্যা করতে চেয়েছিল, এমনকি যে সমস্ত স্থানে জাফরি বা গুলি চালনার মতো কেউ নেই সেখানেও তারা মুসলিমদের হত্যা করে। গুলবার্গ সোসাইটিতে সাম্প্রদায়িক হিংসাকে কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত বলা যায়, যেখানে জাফরির দ্বারা তথাকথিত গুলি চালনার অাগেই কয়েক ঘণ্টা ধরে সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা জড়ো হয়? এই গুণ্ডাদের হঠিয়ে দিতে পুলিশের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল – কিন্তু কেন তারা তা করেনি? এই প্রশ্নগুলোকেই অাদালত অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিল।

এই রায় খোলাখুলিভাবে অাক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্ত করে, দাঙ্গাকারীদের অাক্রমণ থেকে নিজেদের অাত্মরক্ষার জন্য কোনো অধিকারই তাদের দেয়নি। এই রায়ে নিরাপত্তার দায় অাক্রমণকারী ও পুলিশ প্রশাসনের ওপর না দিয়ে অাক্রান্তদের অাচরণের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে, অথচ এ ধরনের অাক্রমণকে রোখার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনেরই ছিল। অাশারাম বাপু যেমন এক সময় বলেছিল ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ধর্ষিতা পাল্টা না রুখে দাঁড়িয়ে ধর্ষণকারীদের ভাই বলে অাহ্বান করে ধর্ষণ এড়াতে পারত, সেইভাবেই এই রায়ের অভিমত হল যে পুলিশ নয়, গুলবার্গে অাক্রান্তকারীরাই সাম্প্রদায়িক খুনেদের হিংসাকে এড়াতে পারত।

এই ধরনের এক রায় ঘোষণা করে বিশেষ অাদালত মোদীর কথাই প্রতিধ্বনিত করল। মোদী ২০০২ সালে গুলবার্গ গণহত্যার জন্য জাফরির গুলি চালনাকেই দায়ী করেন এবং নিউটনের সূত্র এবং ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’র তত্ত্বকে উল্লেখ করে কুখ্যাত হয়েছেন।

বাথানিটোলা রায়েও পাটনা হাইকোর্ট প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নাকচ করে দলিত হত্যায় অভিযুক্ত সকলকেই বেকসুর ঘোষণা করে। অাদালতের যুক্তি ছিল যে গণহত্যার অাগে দলিত গ্রামবাসীরা গুলি চালিয়েছিল।

দাদরি হত্যাকাণ্ডেও অাক্রান্তকেই দায়ী করার একই ধরন দেখা যাচ্ছে। এখানে অাক্রান্ত অাখলাকই যে গরুর মাংস খাওয়ার জন্য ‘অপরাধী’ তা প্রমাণ করার প্রচেষ্টা অাসলে এই হত্যার পিছনে যে সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত রয়েছে তা অাড়াল করা এবং গরুর মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ক্রোধ হিসাবে এই হত্যাকে যুক্তিযু্ক্ত করার চেষ্টা করা।

এখন গুজরাট হত্যালীলার মাথারা, যারা এখন ভারত শাসন করছে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসাকে পুঁজি করে ভোট সংগ্রহ করার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। অাগামী উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে বিজেপি (বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং, স্থানীয় বিজেপি সাংসদ হুকুম সিং সহ) গুজব ছড়াবার চেষ্টা চালাচ্ছে যে মুসলিমদের হুমকির মুখোমুখি হয়ে উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে কইরানা ও কাঁধালা থেকে হিন্দুরা পালাচ্ছে। তবে এটা উৎসাহজনক যে খোদ কইরানা ও কাঁধলার অধিবাসীরা বিজেপির এই প্রচারকে মিথ্যা অাখ্যায়িত করেছেন।

ভারতবাসীকে এটা মেনে চলতে হচ্ছে যে গণহত্যার রাজনৈতিক মাথাদের রয়েছে সুরক্ষা কবচ, বড় জোর দু-চারটে বোড়ে স্থানীয় ব্যক্তি শাস্তি পেতে পারে। গুজরাট গণহত্যায় অভিযুক্ত অারএসএস এবং বিজেপির নেতাদের ও পুলিশের কর্তাদের অাজও বিচার হল না। একই কথা কংগ্রেসের ক্ষেত্রেও সত্য, ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যায় অভিযুক্ত কংগ্রেস নেতাদেরও অাজও বিচার হয়নি। ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যায় অভিযুক্ত কমল নাথকে পাঞ্জাবে পার্টি ইনচার্জ বানানোর জন্য কংগ্রেসের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত (যা অবশ্য প্রতিবাদ ওঠায় প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়) শিখদের ক্ষতে নুনের ছিটে দিয়েছে।

ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে জাকিয়া জাফরি ও গুলবার্গ গণহত্যায় অন্যান্য জীবিতদের প্রচেষ্টা বহু বাধা বিপত্তির সম্মুখীন। সুপ্রীম কোর্টের তৈরি করা এসঅাইটি এই মামলা চাপা দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রেই লিপ্ত হয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন মোদী ও অমিত শাহ এখন তিস্তা শীতলাবাদ ও যাঁরা ন্যায় বিচারের জন্য জীবিতদের লড়াইকে সমর্থন করছেন, সেই সমস্ত সমাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানির অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি উচ্চ অাদালত গুলবার্গ মামলায় বিচারের প্রহসনকে সংশোধন না করে তবে তা হবে ভারতীয় বিচার ব্যবস্থারই লজ্জা।

গুলবার্গ বিচার হল সেই ধরনের বিচার যা সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক অাক্রমণকারীদের ‘প্ররোচনা’ প্রদানের জন্য অাক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্ত করে ভারতবর্ষের সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল মর্মবস্তুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের দ্বারা যে কুখ্যাত জরুরি অবস্থা জারি হয়, ২৫ জুন ২০১৬ হল তার বার্ষিকী। জরুরি অবস্থার বার্ষিকীর অনুষ্ঠান কেবলমাত্র কংগ্রেস সরকারের বা নির্দিষ্ট প্রধানমন্ত্রীর স্বৈরাচারকে নিন্দা জানিয়েই শেষ হতে পারে না, বিপরীতে এটা অবশ্যই হল সাংবিধানিক স্বাধীনতার ধারাবাহিক ও বেপরোয়া লঙ্ঘনকে এবং দলিত, অাদিবাসী, সংখ্যালঘু ও মহিলাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে এক সংকল্প অনুষ্ঠান।

Back-to-previous-article
Top