গুলবার্গ সোস্যাইটি গণহত্যায় আহমেদাবাদ বিশেষ আদালতের রায়ে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং ৩৬ জনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে এবং “প্রমাণের অভাবে” ষড়যন্ত্রের অভিযোগকে বাতিল করা হয়েছে। ঐ রায় কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচারের অনুগামী হয়নি। গুলবার্গ সোস্যাইটি গণহত্যা ছিল ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা হত্যালীলার পরপরই অবাধে চালিত ব্যাপক তাণ্ডবলীলায় সংঘটিত এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। ওই রায়ে বিশ্বহিন্দু পরিষদের কয়েকজন নেতাকে অভিযুক্ত করা হলেও অভিযুক্ত এক বিজেপি কাউন্সিলার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর কে কে এরডাকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।
উন্মত্ত জনতা ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারী গুলবার্গ সোস্যাইটিতে প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরি সহ ৬৯ জনকে হত্যা করে এবং অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায় যাদের পরে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। যারা হত্যাকারীদের হাত থেকে বেঁচে যায় তারা ঐ গণহত্যায় পুলিশ ও প্রশাসনের মদত ছিল বলে অভিযোগ করে। দাঙ্গার ঘটনাগুলোর তদন্তে সুপ্রীম কোর্ট নিয়োজিত বিশেষ তদন্তকারী দল কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে এড়িয়ে যায় যে প্রশ্নগুলো নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন পুলিশ, প্রশাসন ও সরকারের সচেতনভাবে কর্তব্যে অবহেলা উন্মোচিত করতে পারত।
ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগ বাতিল করাকে উচ্চতর আদালতে চ্যালেঞ্জ জানানোর অনেক কারণই রয়েছে। প্রথমত, নারোদা পাটিয়া গণহত্যায় উল্লেখযোগ্য রায়ে — যে গণহত্যা গুলবার্গ সোস্যাইটির মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে সংঘটিত হয় — এটা সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে, মূল অপরাধী বাবু বজরঙ্গি এবং মন্ত্রী মায়া কোদনানি ছিলেন এক ষড়যন্ত্রের চাঁই। ফোন কলের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে, বজরঙ্গি এবং গুলবার্গ সোস্যাইটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত বিশ্বহিন্দু পরিষদ নেতা অতুল বৈদ্য পরস্পরের সঙ্গে যথেষ্ট যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন; ফোন রেকর্ড থেকে এটাও যানা গেছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ঐ গণহত্যার আগের দিন, ২৭ ফেব্রুয়ারী গুলবার্গ সোস্যাইটির আশেপাশেই ছিলেন। আহমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অফিসাররা গুলবার্গ সোস্যাইটির গণহত্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না বলে যে দাবি করেছেন, ফোন রেকর্ড তাকেও মিথ্যা বলে প্রমাণিত করেছে।
ফোন কলের রেকর্ড দেখিয়েছে যে, উচ্চপদের পুলিশ অফিসাররা গুলবার্গ সোস্যাইটিতে গিয়েছিলেন, উন্মত্ত জনতার এক বড় দল যে হিংসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, জনতাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও পুলিশ বাহিনী মোতায়নের নির্দেশ না দিয়েই তারা সেখান থেকে চলে যান। সাক্ষীরা তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন, এহসান জাফরি সাহায্যের জন্য পুলিশ এবং ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এল কে আদবানি এবং গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ সর্বোচ্চ স্তরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে শতাধিক ফোন করেন, কিন্তু কেউই সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। সরকার এবং পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ঘুরিয়ে রেখে উন্মত্ত জনতাকে মহিলাদের ধর্ষণ, এহসান জাফরির নৃশংস হত্যা সহ ৬৯ জনের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে দেয়।
২০০২-এর তাণ্ডবলীলায় রাষ্ট্রের যোগসাজশের সবচেয়ে ঘৃণ্য নিদর্শন হল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীর আচরণ, যিনি আজ প্রধানমন্ত্রী। নারোদ পাটিয়া এবং গুলবার্গ সোস্যাইটির ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড শেষ হওয়ার পর ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় মোদী দূরদর্শনে একটি বক্তৃতা দেন, কিন্তু সেই বক্তৃতায় তিনি শুধু গোধরা হত্যাকাণ্ডেরই উল্লেখ করেন এবং ঐ দুই গণহত্যা সম্পর্কে নীরব থাকেন। বিশেষ তদন্তকারী দলের কাছে তিনি দাবি করেন যে, কেবলমাত্র সেদিন অনেক রাতেই তাকে ঐ গণহত্যাগুলো সম্পর্কে জানানো হয়। বড় বড় পুলিশ অফিসাররা যদি প্রকাশ্য দিবালোকে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নিজেদের এবং মুখ্যমন্ত্রীকে অবহিত করতে না পারেন তবে ঐ অফিসারদের শাস্তি দেওয়া হল না কেন? এর পরিবর্তে তাদের পদোন্নোতি ঘটানো হল কেন?
এর পরদিনই ২০০২-এর ১ মার্চ মোদী একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দেন এবং তাতে গুলবার্গ সোস্যাইটি গণহত্যা এবং বস্তুত সমস্ত দাঙ্গাকেই ‘ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার শৃঙ্খল’-এর যুক্তিতে সমর্থন করেন। মোদী দাবি করেন, জনতার দিকে জাফরির গুলি ছোঁড়ার ক্রিয়াই গণহত্যার ‘প্রতিক্রিয়া’ সৃষ্টি করে। এর থেকে যে প্রশ্নটা উঠে আসে তা হল — পুলিশ এবং সরকার যদি আতঙ্কগ্রস্ত জাফরির আবেদনে সাড়া দিত তাহলে কি খুনে জনতার হাত থেকে গুলবার্গ সোস্যাইটিকে রক্ষা করতে তাকে শুধুই নিজের বন্দুকের উপর নির্ভর করতে হত? গুলবার্গ মামলায় পুলিশ যে চার্জশিট দেয় তাতেও প্রথমে এই দাবিই করা হয় যে জাফরির উন্মত্ত জনতার উপর গুলি চালানোর জন্যই ঐ হিংসাকান্ড ঘটেছিল। পুলিশ অফিসার রাহুল শর্মা যিনি বলেন যে, এই চার্জশিট এফ আই আর-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, তাকে বদলি করা হয় এবং তারপর থেকে তাকে নিগ্রহ ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
মোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার আজও তার ক্ষমতা ব্যবহার করে তিস্তা শিতলওয়াড় (যার নিরলস প্রচেষ্টার জন্যই নারোদ পাটিয়া মামলার রায় এবং গুলবার্গ মামলায় আংশিক ন্যায়বিচার লাভ সম্ভব হয়েছে) এবং ইন্দিরা জয়সিং-এর মতো (যিনি মোদী এবং তার ডান হাত অমিত শাহর মোকাবিলায় রত হয়েছেন) ন্যায়বিচার যোদ্ধাদের হেনস্থা ঘটাচ্ছেন ও লাঞ্ছনার শিকার করে তুলছেন।
সাংবাদিক রানা আয়ুব গুজরাট ফাইলস নামে সম্প্রতি একটি বই প্রকাশ করেছেন, যাতে স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে কথপোকথন বিশদে বর্ণিত হয়েছে। এই বইও ২০০২-এর তাণ্ডবলীলায় রাষ্ট্রের মদতকে প্রমাণ করছে। ঐ কথপোকথনগুলোতে তাণ্ডবলীলা চলার সময়কার স্বরাষ্ট্রসচিব অশোক নারায়ণকে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, মোদী দাঙ্গায় বিশ্বহিন্দু পরিষদকে সমর্থনের জন্য তার পছন্দের ও বিশ্বস্ত পুলিশ অফিসারদের মৌখিক নির্দেশ দিতেন এবং মোদী তা করতেন ‘হিন্দু ভোট’-এর জন্য। কথপোকথনে তাণ্ডব চলার সময়কার আহমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার পি সি পাণ্ডেকেও সাম্প্রদায়িক হিংসার সমর্থন করতে শোনা গেছে, কেননা তার কথা অনুযায়ী আগের দাঙ্গাগুলোতে মুসলিমরাই কর্তৃত্ব করত আর তারই প্রতিশোধ হল এই দাঙ্গা।
কংগ্রেসের মদতে চালিত ১৯৮৪-র শিখ-বিরোধী গণহত্যাই হোক বা মোদীর নেতৃত্বাধীন গুজরাট সরকারের মদতে সংঘটিত ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যাই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিশন এবং আদালত দাঙ্গার শিকার এবং দাঙ্গায় বেঁচে যাওয়া মানুষদের ন্যায়বিচার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক চাঁইদের গায়ে আঁচড় লাগেনি; গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে; খুব বেশি হলে কিছু চুনোপুঁটিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
২০০২-এর গণহত্যার চাঁইরা এখন কেন্দ্রের ক্ষমতায় এবং ন্যায়বিচার বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু জাকিয়া জাফরিসহ দাঙ্গায় বেঁচে যাওয়া অকুতভয় মানুষরা এবং অন্যান্য ন্যায়বিচার যোদ্ধারা কিন্তু লড়াইটা ছাড়বেন না। তাদের এই লড়াইয়ের পাশে ভারতের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকেই সমাবেশিত হতে হবে।