(কমরেড সরোজ দত্তকে মনে রেখে)
Then I realized I had been murdered
They looked for me in cafes, cemetaries and churches
… but they did not find me
They never found me?
No. They never found me
গার্সিয়া লোরকা (“The fabble and Round of the Three Frineds”, Poet, নিউ ইয়র্ক, ১৯৩৯)
কি অাশ্চর্য সমাপতন, অাগস্ট (১৯) ১৯৩৬, অাগস্ট (৫) ১৯৭১। ১৯৩৬-এর ১৯ অাগস্ট ফ্যাসিস্ট স্প্যানিশ জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যালানজিস্ট দুষ্কৃতিদের হাতে খুন হলেন স্পেনের জগৎ বিখ্যাত কবি, নাটককার, নাট্য-পরিচালক ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকা। না, তিনি একা নন, “The Assassination of Garcia Lorca” গ্রন্থের লেখক ইবান গিবসন লিখছেন, “লোরকার অারও তিন বন্ধু জ্যাকুলিন অারকোলাস, ফ্রান্সিসকো গ্যালাভি মার্গেল, গ্যালিনভো গঞ্জালেস, ওঁদের সকলকেই কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে ফ্র্যাঙ্কোর Assault Guards-এর ঘাতকরা।” সত্যটা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। নীল জামা গায়ে রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী তখন হত্যা করে চলেছে মার্কসিস্ট পপুলার ফ্রন্টের হাজার হাজার কর্মী ও সংগঠককে। ১৯৩০-এর বিশ্ব মন্দার (গ্রেট ক্রাশ) হাত ধরে ইতালি, জার্মানি, স্পেন, অারও অারও দেশে তখন ফ্যাসিস্ট শক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তি ও প্রাইভেট কর্পোরেট হাউসের সম্মিলিত গুণ্ডারা তখন ব্ল্যাক শার্ট-ব্রাউন শার্ট-ব্লু শার্ট গায়ে চাপিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠেছে। ফ্যাসিজম, নাৎসিজম বা স্বৈরাচারের সেই বর্বরতা ও গণহত্যার কাহিনী ইতিহাস এখনও ভুলে যেতে পারেনি।
অামরাও কি ভুলে যেতে পেরেছি ‘৭০-এর সেই গণহত্যার দিনগুলোর কথা! ভারতের বুর্জোয়া অর্থনীতি ও রাজনীতির সংকট-জাত ইন্দিরার ফ্যাসিস্ট জমানা এ রাজ্য থেকে শুরু করে গোটা দেশে নিকেষ করে চলেছে একটি বিপ্লবী প্রজন্মকে। বারাসাত, কোন্নগর, মেদিনীপুর, হাওড়ার জেল ও থানা লক-অাপগুলোতে হত্যা করে চলেছে অসংখ্য কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে। এই অাগস্ট মাসেই (১৯৭১) রাষ্ট্রশক্তি ও ফ্যাসিস্ট গুণ্ডাদের হাতে খুন হলেন এক কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বিপ্লবী নেতা – কমরেড সরোজ দত্ত। হত্যার শোক তখনও শেষ হয়ে যায়নি। কাশীপুর-বরানগরে সংগঠিত হল বর্বর গণহত্যা। কবি ও বিপ্লবীরা বোধহয় সমাজ পাল্টাতে এভাবেই খুন হন। লোরকা থেকে সরোজ দত্ত – এভাবেই ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে থাকেন।
কথা এখানেই থেমে যেতে পারতো। কিন্তু সত্যের সন্ধানে মানুষের নিরন্তর যাত্রার ইতিহাস কখনও থেমে যেতে পারে না। ২০০৯-এর অক্টোবর মাসের শেষের দিকে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও অার্কিওলজিস্ট অালফাকার অঞ্চলে খনন-কার্যে ব্রতী হলেন নিহত গার্সিয়া লোরকার মৃতদেহ খুঁজে বার করার জন্য। এগিয়ে এলেন সেই ব্যক্তি, যিনি তিন দশক অাগেই দাবি করেছিলেন লোরকার মৃতদেহ শায়িত করার জন্য কবর খোঁড়ার কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। ফ্র্যাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট জমানার ইতিহাসের মুখোমুখি হতে গোটা স্প্যানিশ জনগণ উদগ্রীব হয়ে অাছেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের ও গণহত্যার (সিভিল ওয়ার) কারণ তাঁদের জানতেই হবে। বিচারপতি বলটাজার গার্জো সমস্ত স্থানীয় প্রশাসন (লোকাল গভর্ণমেন্ট) ও চার্চ গুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, ১৯৩২-১৯৭৫ – যে হাজার হাজার মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়ে গিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের সম্বন্ধে যাবতীয় ফাইল ও তথ্যাবলী বিচারপতির কাছে জমা দিতে হবে। ২০০৯-এর নভেম্বরের শেষে খনন-কার্য শেষ করার পর সংগৃহীত হাড়গোড়-বুলেট শেল ও বস্ত্রাংশ গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। লোরকার অাত্মীয়-পরিজনও ডি এন এ টেস্টের জন্য যাবতীয় সহায়তায় রাজি। ২০১২-র জানুয়ারী “লোরকার জীবনের শেষ ১৩ ঘণ্টার সঙ্গী” গ্রন্থের লেখক ও স্থানীয় ইতিহাসবিদ ক্যাবালেরো পেরেজ অাধ কিলোমিটার দূরে লোরকার দেহের অবশিষ্টাংশ অারও একটি স্থানে খুঁজে দেখার জন্য বিচারপতির কাছে অাবেদন জানিয়েছেন। ১৯৩৬ থেকে ২০১২ – কত বছর। সকলেই হিসাব করে নিতে পারবেন।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ (!) ও বাম অান্দোলনের অন্যতম দূর্গ এ ভারত বা এ বাংলায় শহীদ সরোজ দত্ত ও তাঁর নিহত ও শহীদ সাথীদের ইতিহাসকে জনসমক্ষে হাজির করতে বিচারালয়ের ‘ন্যায়াধীশরা’ রাজি হননি। রাষ্ট্রের ও সরকারের কর্ণধারদের কথা তো ওঠেই না। সত্যকে চাপা দিতেই ‘ভদ্রলোকেরা’ বেশি ব্যস্ত ! কিন্তু নতুন প্রজন্ম নিজের বিপ্লবী ইতিহাস সম্পর্কে এতো নিষ্পৃহ থাকতে পারে কি ?
“Not only did he lose his life
By shots assassinated
But with a hammer and a knife
was after that”
(দক্ষিণ অাফ্রিকার রোমান ক্যাথলিক কবি Roy Campbell, The martyrdom of F Garcia Lorca)
না, ক্যাম্পবেল কোনো কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব নন। স্পানিশ গৃহযুদ্ধের দিনগুলোতে এবং পরেও তিনি ‘ন্যাশনালিস্ট’-দের পক্ষেই ছিলেন। তথাপি লোরকার এই নৃশংস হত্যাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। অামাদের এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবীকুল ও কবি-সাহিত্যিকরা যাঁরা পা-পিছলে স্বৈরাচারের পক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বা অাজও যান, তাঁরা কি ক্যাম্পবেলের এই কবিতার মর্মকথা বুঝে উঠতে পারবেন?
কমরেড সরোজ দত্তরা কিভাবে সৃষ্টির উল্লাসে মেতে ওঠেন। তীক্ষ্ণ বর্শাফলকের মতো ধারালো শব্দবাণগুলোকে তাঁরা কিভাবে খুঁজে পান ? এর উৎস খুঁজে বার করার জন্য অামাদের অাবার ইতিহাসের মুখোমুখি হতে হবে। “অগ্রণী”র প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, অাগস্ট ১৯৩৯-এ সরোজ দত্তের “কোনো বিপ্লবী কবির মর্মকথা”– কবিতাটি অাবার পড়ছিলাম। যে কবিতার প্ৰথম ও শেষ লাইন দুটোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক : অামার কবিতা কভু কহিবে না অামার কাহিনী … অার শেষ লাইন এরকম : দুঃসাহসী বিন্দু অামি, বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা।
“অামার কাহিনী” না বলে কার কাহিনী তিনি অামাদের সামনে উন্মুক্ত করেছেন? সময়টা একটু স্মরণ করুন : ঠিক একমাস বাদে শুরু হতে চলেছে বিশ্ব ইতিহাসের সেই বর্বরতম কালো ইতিহাস – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাজার দখলের সেই ভয়ঙ্কর পাশাখেলায় যুদ্ধবাজ বুর্জোয়া ও ফ্যাসিস্টরা মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। ১৯৩০-এর ‘মহামন্দা’ যখন কোনো টোটকা ওষুধে সারছে না, তখন যুদ্ধবাজরা যুদ্ধ ছাড়া অার কি বা করতে পারে ? এই যুদ্ধবাজ বুর্জোয়া ও ফ্যাসিস্টদের স্বরূপ উন্মোচন করা, তাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের প্রাচীর তৈরি করার কাজই সংবেদনশীল কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রধান কাজ। কোনো ভীরুতা, কোনো পলায়নবাদ কবির কাছে কাম্য নয়। একথাই এ কবিতার শেষ লাইনে বিধৃত : দুঃসাহসী বিন্দু অামি …। কবি সমসময় ও জগৎ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারেন না। যাঁরা পালাতে চান, তাঁরা অবক্ষয়ীদের সমর্থনে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু কোনো বিপ্লবী সৃজনে যুক্ত মানুষ তাঁর সমকালকে এড়াতে পারেন না, কেননা, “… প্রতিটি লোকই তার কালের সৃষ্টি” (বাংলার পার্টি প্রভাবিত শিল্প-সাহিত্যে শোধনবাদীদের ভূমিকা দ্রষ্টব্য)। কথাটা কার্ল মার্কসের। একজন মার্কসবাদী কর্মী হিসাবে সরোজ দত্ত অাজীবন তাঁর সময়কে প্রতিফলিত ও প্রতিধ্বনিত করার জন্য কলম ধরেছিলেন। লোরকা যদি ফ্যাসিস্ট ফ্র্যাঙ্কোর বিরুদ্ধে কলম ধরার ‘অপরাধ’ করে থাকেন, তবে সরোজ দত্ত-ও তাঁর ‘সমকালের ক্লীবত্ব’, ‘বৃহন্নলা বৃত্তি’-র বিরুদ্ধে কলমে শান দিয়েছেন। সরোজ দত্ত তাই লিখছেন, “অাজ অামাদের দেশের বিশেষত বাংলাদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকদের কর্তব্য একদিকে যেমন শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করা অন্যদিকে তেমনই শোধনবাদের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে প্রকৃত মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে এবং জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হওয়া (ঐ)। অসাম্য ও শোষণ-ক্লান্ত এই বধির সমাজকে যদি কিছু শোনাতে হয়, তবে শব্দগুলো একটু কর্কষ হবেই, ভাষা যথেষ্ট তীক্ষ্ণ ও ধারালো করা ছাড়া উপায় কি?
যে মানুষটির কাছে বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো “উৎসব” নেই, সেই মানুষটি বিপ্লবের কাছে বাধাস্বরূপ যে কোনো প্রতিষ্ঠান, যে কোনো চিন্তা-ভাবনা ও মতকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবেনই। শ্রমিক-কৃষক নতমস্তকে ‘মনীষী’ পূজায় ব্যস্ত রাখার যে অপসংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে বহমান, তাকে এক ঝটকায় উন্মোচিত করার কাজ কারও কারও কাছে ‘কালোপাহাড়ি’, ধ্বংসযজ্ঞ বলে মনে হতেই পারে, কিন্তু এছাড়া ভিন্ন পথ অার কি হতে পারতো? ‘অতিপরিশীলিত’, ‘সুচিন্তিত’, ‘ধীর-স্থির’ পথ গবেষণাগারে চর্চার বিষয়বস্তু হতেই পারে, কিন্তু যুগ যুগ লালিত যে অন্ধত্ব অামাদের প্রশ্ন করার স্পৃহাটুকু পর্যন্ত শেষ করে দিয়েছে, তাকে ধাক্কা মারতেই চেয়েছিলেন তিনি। স্বল্প সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে নিশ্চিত এতে ‘বাড়াবাড়ি’ ছিল, ‘কালোপাহাড়ি’ উন্মত্ততা ছিল, কিন্তু সময়ের ল্যান্ডস্কেপটা যদি অারও একটু বাড়িয়ে নেওয়া যায়, তাহলে অাজ অামরা বুঝতে পারব কিভাবে শিক্ষাব্যবস্থায়, প্রতিষ্ঠান বন্দনায় শ্রমিক-কৃষক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতেই অামাদের সহায়তা করে। অাজকের ‘উন্নয়ন’ যজ্ঞে সেই বুনিয়াদী জনগণকে ব্রাত্য করে রাখার যে অভিযান চলছে, তার মৃতদেহ ও হাড়গোড়ের ওপর যেভাবে উন্নয়নের ইমারত উঠছে ও তার সমর্থনে একদল বুদ্ধিজীবী (পরবর্তীকালে খেতাব প্রাপ্ত মনীষী) উল্লাসনৃত্য করছে – কমরেড সরোজ দত্ত দূরদৃষ্টিতে তা হয়তো ধরতে পেরেছিলেন। কবিরা দূরদ্রষ্টা।
বিপ্লবীরা নিছক ‘এপিটাফ’ লেখেন না, তাঁরা অগ্রণী বিপ্লবীদের জীবনচর্চা ও সৃষ্টিকর্মকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেন। অাজ ৩০-এর দশকের মতোই মহামন্দা ও ফ্যাসিবাদ তার সমস্ত শক্তি নিয়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করতে উদ্যত। তখন অারও অারও “দুঃসাহসী বিন্দু” সিন্ধুর চেতনা নিয়ে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন, এ ভরসা অামাদের রাখতেই হবে।