অাট জন শ্রমিককে দ্বিতীয় বারের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে লড়াই করার ‘অপরাধে’ এবং ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করার জন্যই তাঁদের দেওয়া হয়েছে এই সাজা। সম্ভবত এটাই হল প্রথম এমন এক ঘটনা, যেখানে শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এরকম এক রায় দেওয়া হয়েছে, অার যেখানে শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে পুঁজিপতি/কর্পোরেট ঘরানার তীব্র ঘৃণা, পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ও শত্রুতা পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠেছে। রায়দানের বার্তা খুবই স্পষ্ট – যদি তুমি মাথা তুলে দাঁড়াও, যদি তুমি তোমার পছন্দমতো ইউনিয়ন গঠন কর, যদি তুমি তোমার অধিকার ও মজুরি সংক্রান্ত ব্যাপারে কথাবার্তা বল, তোমাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। গোটা দেশজুড়ে লাগাতারভাবেই শ্রমিকশ্রেণীকে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রিকল লিমিটেড অটোমোবাইল যন্ত্রাংশের উৎপাদক এবং কোয়েম্বাত্তুর, পুনে, গুরগাঁও ও উত্তরাখণ্ডে রয়েছে তাদের ইউনিট। বিদেশে, যেমন ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলেও রয়েছে তাদের ইউনিট। রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, ভ্রমণ, অাতিথেয়তা ক্ষেত্রে রয়েছে এদের কারবার।
প্রিকল লিমিটেড-এর শ্রমিকরা (কোয়েম্বাত্তুর) শ্রমকানুন রূপায়ণ এবং অাইন মোতাবেক মজুরির দাবিতে অান্দোলন করছিলেন। এজন্য তাঁরা নিজেদের ইউনিয়ন গঠন করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে কোয়েম্বাত্তুর সেশন কোর্ট (দায়রা অাদালত) প্রিকল ইউনিয়নের (কোয়েম্বাত্তুর জেলা প্রিকল ওয়ার্কার্স ইউনিটি ইউনিয়ন) ৮ জন শ্রমিক – গুনাবালান, মনিভান্নান, রাজেন্দ্রন, রামামূর্তি, সম্পত কুমার, সরভান কুমার, শিবকুমার ও ভি ভেলমুরুগন-কে দু-দুবারের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছে।
শ্রমিক অান্দোলনের ওপর এক পরিকল্পিত অাক্রমণ : ‘কোনো ধরনের অপরাধ বা এমনকি খুনের সাক্ষ্য না পাওয়া গেলেও এই রায়দানের নির্মমতা প্রমাণ করে যে অার যাই হোক, এটা কয়েকজন অভিযুক্ত শ্রমিকের বিরুদ্ধে সাধারণ এক বিচার নয়। বরং এটা হল, ভারতের শ্রমিক অান্দোলনের ওপর এক পরিকল্পিত সতর্কবার্তা – শ্রমকানুন ও ইউনিয়নের ওপর হালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হামলা মেনে নাও, নচেৎ অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে।’
স্পষ্টতই বোঝা যায় যে শ্রেণীযুদ্ধে এই রায় কর্পোরেটদের স্বার্থে রচিত হয়েছে সেই একই পথ ধরে, যেখানে বিহারের বাথানিটোলা ও লক্ষ্ণণপুর বাথের দলিত গণহত্যার খুনিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, অার বিপরীতে জেহানাবাদে সামন্ত শক্তির হাত থেকে নিজেদের পুকুর (?) বাঁচাতে অান্দোলনরত ১৪ জন কৃষককে ২০০৩ সালে টাডা অাইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা একজনেরও জীবন কাড়েনি। বার্তাটা পরিষ্কার – দরিদ্র, শ্রমিক এবং দলিতদের রক্ত হিসেবের মধ্যে ধরা হয় না। অার, ধনী ও ক্ষমতাবান, পুঁজিপতি ও সামন্তবাদী শক্তিদের অপরাধগুলোকেও অাদৌ গণ্য করা হয় না অপরাধ হিসাবে।
এবার এমনই একটা উদ্যোগ নেওয়া হল যাতে ভারতবর্ষের শ্রমিকদের এটা শিক্ষা দেওয়া যায় যে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপকে সংগঠিত অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদের সমগোত্রীয় হিসাবেই গণ্য করা হবে – অার শাস্তি দেওয়া হবে নির্মম সাজা ঘোষণা করে। মানেসর (মারুতি), নয়ডা (গ্রাসিঅানো) ও শাহিবাবাদ (অ্যালায়র্ড নিপ্পন) সহ গোটা দেশের বহু জায়গায় শ্রমিকদের বছরের পর বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
শিকাগোর হে মার্কেটে যে ৮ জন শহীদ শ্রমিকের স্মরণে দুনিয়াজুড়ে এখনও ১ মে শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়, তাদেরও ষড়যন্ত্র ও হ্ত্যার মতো মিথ্যা মামলায় শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাঁরা শ্রমিকদের স্বার্থে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে লড়াই করেছিলেন। অাজ ১৩০ বছর পরেও অান্দোলনরত শ্রমিকদের একইভাবে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেদিন শ্রমিকশ্রেণী বিজয়লাভ করে এবং অর্জন করে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। সমস্ত ধরনের ষড়যন্ত্র এবং পুঁজিপতি শ্রেণী কর্তৃক মিথ্যা মামলা সত্ত্বেও শ্রম ও মজুরির লুঠের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী অাজও বিজয় অর্জন করবে।
প্রিকলে হয়েছিলটা কী? অার তারপর কোর্টেই বা কী হয়েছিল?
সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ প্রিকল মানবসম্পদ বিভাগের সহ সভাপতি রায় জে জর্জ-এর মর্মান্তিক মৃত্যু, যা এই মামলায় ষড়যন্ত্রের বনিয়াদ হিসাবে সামনে এল, সেই ঘটনার পূর্বেকার ঘটনাক্রম নিয়ে অালোচনা করব। ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও শ্রমিকদের সফল অান্দোলনকে অাক্রমণ করতেই ঐ ঘটনাকে একটা অজুহাত হিসাবে সমানে অানা হয়েছে। শ্রমকানুন, অাদালতের রায় এবং সরকারী নির্দেশনামা হেলায় লঙ্ঘন করার ব্যাপারে প্রিকল কর্তৃপক্ষ কুখ্যাত। ব্যাপক শ্রমিকের সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন তো দূরস্থান, কর্তৃপক্ষ লাগাতারভাবে শ্রমিকদের ওপর নানান দমন নামিয়েছিল ইউনিয়নকে সমর্থন করার জন্য এই অাশা নিয়ে যে এইভাবে তারা ইউনিয়নকে ভাঙ্গতে সফল হবে। ‘শাস্তি’ হিসাবে বিরাট পরিমাণে মজুরি কেটে নেওয়া হয়। ফলে মাথা পিছু শ্রমিক বঞ্চিত হন দশ হাজার টাকা করে। তা সত্ত্বেও প্রিকলের শ্রমিকরা বুক টান করে সংগ্রামী মেজাজকে অক্ষুণ্ন রেখে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যান ধারাবাহিকভাবে।
২০০৭ সাল থেকে প্রিকল কর্তৃপক্ষ বেঅাইনিভাবে শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা ও মজুরি বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করে। ফলে মাথা পিছু একজন শ্রমিকের প্রতি মাসে লোকসান হয় ৯৫০ থেকে ১৬০০ টাকা। ইউনিয়ন এই বিষয়টা নিয়ে উদ্যোগ নেয়, চাকরি থেকে ইউনিয়ন নেতৃত্বকে বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই নালিশ করে শ্রমদপ্তর ও রাজ্য সরকারের কাছে। প্রত্যুত্তরে সরকার ২০০৯-এর মার্চ মাসে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক নোটিশ জারি করে। এছাড়াও, কর্তৃপক্ষের প্রতিটি বোর্ড সদস্যের বিরুদ্ধে অন্যায্য শ্রম অনুশীলন বা অানফেয়ার লেবার প্র্যাকটিসের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। জানতে চাওয়া হয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য কেন সেই সমস্ত শ্রমিককে মজুরি বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সমস্ত নথি ও প্রামাণ্য কাগজপত্র সহ ইউনিয়ন এটাও দেখায় যে সম্পূর্ণ বেঅাইনি পথে কারখানার মূল উৎপাদন কেন্দ্রে কর্তৃপক্ষ অ্যাপ্রেন্টিস ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিককে নিয়োগ করেছে। বাধ্য হয়ে সরকার ১৫ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে অারেকটা বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্তৃপক্ষকে জানায় যে ঐ সমস্ত কাজে যেন অ্যাপ্রেন্টিস বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ না করা হয়। কর্তৃপক্ষ এই বিজ্ঞপ্তির তোয়াক্কা করেনি। ফলে ২১-২২ মে তারিখে কারখানায় অাচমকা এক পরিদর্শন হয় অার বেঅাইনিভাবে অ্যাপ্রেন্টিস ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিককে নিয়োগ করার ঘটনায় কর্তৃপক্ষ হাতে-নাতে ধরা পড়ে। এরপর ইউনিয়ন দাবি তোলে, সরকার যেন প্রিকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক অাইনি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ১৫ জুন থেকে এই দাবির সমর্থনে প্রিকলের শ্রমিকরা শুরু করেন অনির্দিষ্ট অনশন ধর্মঘট।
এই অনশনের বার্তা গোটা রাজ্য জুড়েই ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য ইউনিয়ন, এমনকি সাধারণ মানুষও অনশনরত শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করতে অাসেন। অান্দোলনের সমর্থনে কয়েক লক্ষ প্রচারপত্র বিলি করা হয়। পার্শ্ববর্তী হাইওয়েতে টাঙানো হয় ব্যানার। শ্রমিক, ইউনিয়ন ও জনগণ প্রচণ্ড সাড়া দেয়। সংগ্রামী অাবেগ ও লড়াকু মেজাজ বাড়তে থাকে প্রতিদিন। রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী, ইউনিয়ন, সামাজিক অনুশীলনরত কর্মী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ লাইন করে দাঁড়িয়ে সাক্ষাত করেন অনশনরত শ্রমিকদের সঙ্গে। অাবেগঘন মুহূর্ত তুঙ্গে ওঠে, যখন দেখা যায় সন্তানরা তাদের অনশনরত মা-বাবার সঙ্গে দেখা করছে।
১২ দিন পর অনশনরত কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। অন্যান্য অনশনরত শ্রমিকরা তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে যতক্ষণ না তামিলনাড়ু বিধানসভায় তাঁদের বিষয় নিয়ে অালোচনা হচ্ছে, বা তাদের দাবি সুষ্ঠু মীমাংসার পথে যাচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা অনশনে অটল থাকবেন।
ইউনিয়নের এই অান্দোলনের চাপে তামিলনাড়ু সরকার বিধানসভায় অালোচনা সংগঠিত করতে বাধ্য হয় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই প্রিকল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার মীমাংসা করা হবে। বিধানসভায় এই মর্মে এক বিবৃতি জারি হয় যে, ইউনিয়নের দাবিগুলো মেনে নেওয়ায় ইউনিয়নের অনির্দিষ্টকালীন অনশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে। একদিন অাগে, ২৯ জুন ২০০৯ তারিখে শ্রমদপ্তর এক অাদেশবলে জানায় যে মূল উৎপাদন কেন্দ্রে কর্তৃপক্ষ অ্যাপ্রেন্টিস বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ করতে পারবে না। একইসাথে শ্রমদপ্তর কর্তৃপক্ষকে এই নির্দেশ দেয় যে, সমস্ত শ্রমিককে মজুরির পাশাপাশি ১ জুন ২০০৯ থেকে মাসিক অন্তর্বর্তীকালীন রিলিফ বাবদ যেন ৫০০ ও ৪০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
সারা দেশজুড়ে এই ঐতিহাসিক অাদেশনামাটির বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে যখন কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের খোলাখুলিভাবে নিয়োগ করা হচ্ছে তখন এরকম এক অাদেশনামা কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়। প্রিকল শ্রমিকরা তা অর্জন করেছেন এক দীর্ঘস্থায়ী, পরিকল্পিত সংগ্রামের মাধ্যমে।
সরকার ঐ অাদেশনামা জারি করলেও কর্তৃপক্ষের দিকেই ছিল তাদের সহানুভূতি। নাছোড় কর্তৃপক্ষ ঐ অাদেশনামা রূপায়িত করার বদলে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে যাতে পুরো বিষয়টাকেই বিলম্বিত করা যায়।
এ অাই সি সি টি ইউ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড কুমারস্বামী অাবার হাইকোর্টেরও একজন প্রবীণ অাইনজীবী। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে তামিলনাড়ু হাইকোর্টে শ্রমিকদের পক্ষে তাঁর দাঁড়ানোর কথা ছিল। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে কমরেড কুমারস্বামী সহ ২৬ জনকে খুনের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়, যাতে তাঁরা হাইকোর্টের উপরোক্ত মামলায় প্রকৃত বিচার না পান।
কিভাবে কোর্টে মামলাটা এগোল? পুরো ঘটনায় ইউনিয়ন কর্মী ও নেতা সহ মোট ২৭ জন শ্রমিককে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন এ অাই সি সি টি ইউ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড এস কুমারস্বামী, যিনি ঐ ঘটনার দিনে কোয়েম্বাত্তুরের ধারেকাছেও ছিলেন না। প্রিকলে এ অাই সি সি টি ইউ-র নেতা এম গুরুস্বামীকেও এই মামলায় ফাঁসানো হয়, যিনি সেই সময়ে প্রিকল প্ল্যান্ট ১-এ কর্মরত ছিলেন না। এটা জানা যায় যে একেবারে শেষমুহূর্তে তাঁর নাম এফ অাই অার এবং অভিযোগের তালিকায় যুক্ত করা হয়।
যেহেতু কোর্টের কাছে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছিল না, তাই ২৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৯ জনকে বেকসুর খালাস করা হয়। তবে ৮ জনকে কেন অভিযুক্ত করা হল ?
বিচার প্রক্রিয়ায় খুনের ষড়যন্ত্র প্রমাণ করা গেল না। তাহলে তো এটাই স্বাভাবিক, তার ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার সবটাই মিথ্যা। এ অাই সি সি টি ইউ-র নেতা কুমারস্বামী ও গুরুস্বামী নিঃশর্তে মুক্তি পান কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কমরেড গুরুস্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো যদি এতই নগ্নভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে থাকে তবে অন্যান্য শ্রমিক সহ গোটা মামলাটি নিয়েই কেন প্রশ্ন উঠবে না?
অারও একটি প্রশ্ন হল – যে সমস্ত ইউনিয়ন নেতারা ২০০৭ সাল থেকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ অান্দোলনের পরিকল্পনা করে চুক্তি সম্পাদন করতে সফল হন, তারাই বা কেন ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটবেন? ইউনিয়ন পরিচালনা করা তো কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কাজ নয়। তার সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের ওপর, হত্যা সংগঠিত করার ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে নয়।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রকৃত তথ্য-প্রমাণ কি ছিল?
১। রায়ে উল্লেখ হয়েছে খুন করা হয়েছে ৮টি লোহার রড দিয়ে – তাই, এখান থেকে এটা বোঝাই যায এর পেছনে অাটজন অভিযুক্ত রয়েছেন। অভিযুক্ত ঐ অাটজন ব্যক্তির সঙ্গে অাটখানা লোহার রডের সম্পর্কের কি প্রমাণ মেলে তা অারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার্য বিষয় – যার সঙ্গে এই বিচারের পরিণতির কোনো সম্পকই নেই। অামরা দেখলাম, জর্জের রক্তের কোনো চিহ্ন রডগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোহার রডগুলোতে (যেটাকে খুনের অস্ত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে) অভিযুক্তদের কোনো অাঙ্গুলের ছাপেরও হদিশ মেলেনি। এদিকে, মামলায় বলা হয়েছে জর্জের শরীরে অাটটি ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে (যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে অাটখানা লোহার রড), কিন্তু যে ডাক্তার জর্জকে ভর্তি করিয়েছিলেন, তিনি জানান যে জর্জের শরীরে ছিল মাত্র একটি ক্ষত চিহ্ন, অার ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী ছিল তিনটে ক্ষতচিহ্ন। সংখ্যাগতভাবে লোহার রড বা খুনের অস্ত্র হিসাবে সেগুলোকে ব্যবহার করা অথবা তার সঙ্গে অাটজন ‘খুনি’ শ্রমিকের কোনো সম্পর্কের তথ্যপ্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
২। মামলাটি স্পষ্টতই নানা মিথ্যাচারে ভরা। এমনকি তাদের নিজস্ব সাক্ষীরাও তা অস্বীকার করে। এমন অকাট্য তথ্য পাওয়া গেছে যা প্রমাণ করে যে পুরো বিষয়টাই সাজানো। উদাহরণস্বরূপ, কয়েকজন অভিযুক্ত মামলা খারিজ করার লিখিত পাল্টা এক ডিসচার্জ পিটিশনে জানান যে, সিসি টিভি রেকর্ডিং শুধুমাত্র ঘটনা ঘটার সময় ও স্থানকেই দেখায়নি, বরং এমন কয়েকজন ব্যক্তির পরিচিতিকে উদ্ঘাটিত করেছে যাদের নাম ও কয়েকজনের খোলাখুলি কার্যকলাপ এফ অাই অার-এ লেখা নেই। কিন্তু ঐ সিসি টিভির ফুটেজ যখন কোর্টে পেশ করা হল, তখন কিন্তু সেগুলোর অার দেখা মিলল না। মামলায় সাক্ষী-সাবুদের সাক্ষ্যপ্রমাণে এই সাধারণ দ্বন্দ্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিচারক অাই ও (ইনভেস্টিগেটিং অফিসার)-র বক্তব্যকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, যিনি বলেছেন যে ২১ সেপ্টেম্বর সিসি টিভি কাজ করেনি। বিচারকের অবশ্যই অাই ও-কে প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে, যদি অাই ও জানতেন সিসি টিভি কাজ করেনি তবে তার অাগে মামলায় লিখিতভাবে ঠিক তার উল্টোটাই কেন লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল? এখান থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে সত্যিটা বেরিয়ে অাসে তা হল, সিটি টিভির ফুটেজটা সম্ভবত চেপে রাখা হয়েছিল কারণ তা এমন সব তথ্য উদ্ঘাটিত করত যা প্রিকল কর্তৃপক্ষের দায়ের করা মামলার বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের অস্বস্তিতে ফেলত। কিন্তু বিচারের সময় এই সমস্ত বিচার্য হল না। কেন?
৩। বলা হচ্ছে মানবোন্নয়নের সহ সভাপতির কামরায় ঘটনাটি ঘটে সকাল ১১.৪০ মিনিটে। যদিও অাই ও বলেছিলেন তিনি ঐদিন সকাল ১১.৪১ – ১১.৪৬ পর্যন্ত কামরার বাইরে ছিলেন। প্রিকলের মানবোন্নয়ন বিভাগের বা সশস্ত্র সংরক্ষিত পুলিশবাহিনী (যাদের এক বছরেরও অাগে প্রিকলে নিয়োগ করা হয়) – এরা কেউই অাই ও-কে এমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা সম্পর্কে জানায়নি। একথাও তাকে জানায়নি যে অাহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন ছিল। তিনি হলেন মামলার এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী, যিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছেন যে খুন যেখানে সংগঠিত হয়েছিল, তিনি ঠিক তার বাইরে উপস্থিত ছিলেন – তা সত্ত্বেও তিনি নাকি কোনো খুনিকে পালাতেও দেখেননি। কোনো ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনাও তার গোচরে অাসেনি। এত কিছু সত্ত্বেও মামলায় তাকে বিরুদ্ধভাবাপূর্ণ সাক্ষী (হোস্টাইল ভিটনেস) হিসাবে ঘোষণা করা হল না। এছাড়া, প্রায় ১০০০-র বেশি শ্রমিক, শ’য়ে শ’য়ে অফিসার, ডাইরেক্টর বা অাহত ব্যক্তি অথবা যারা চাক্ষুষ দেখেছেন – এমন কেউ পুলিশকে ফোনে বা থানায় (যার দূরত্ব বড়জোর দশ মিনিট হবে) খবর দিয়েছে – তার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
৪। মামলায় সিসি টিভি ফুটেজের মিথ্যাসর্বস্ব ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিযুক্তদের অাগেকার লিখিত ঘটনাগুলোর চেয়ে অাই ও-র বক্তব্যকেই বেশি নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে। অাই ও-র বক্তব্যের ওপর বেশি নির্ভর করা মামলাটির রায় অাই ও-র অস্বস্তিকর ও স্ববিরোধী বক্তব্যগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে অানেনি। রায়দানের সময় শুধু এটা বলা হয়েছে যে মামলা চলাকালীন অাই ও-র উল্টো সাক্ষ্যদান ”দুর্ভাগ্যজনক” ছিল।
৫। বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মামলায় বলা হয়েছে, অাহতদের ধাপে ধাপে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে (যে অাহত ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে যুঝছিলেন তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় দুপুর ১.২২ মিনিটে, অার বাকিরা ভর্তি হয়েছিল দুপুর ২.৩০, ৩.০০ ও ৩.৩০ (এর মধ্যে)। কিন্তু যে নার্স অাহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিয়ে যান, তিনি জানান যে তিনিই তাদের হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সেখানে ১৫ মিনিট থাকার পর ঐ একই অ্যাম্বুলেন্সে কারখানায় ফিরে অাসেন। অ্যাম্বুলেন্সের রেজিস্টারে লেখা রয়েছে যে কারখানা থেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সটি অাহতদের নিয়ে ১১.৫০ মিনিটে যায় এবং ফিরে অাসে দুপুর ১টায়। মামলায় বিলম্বকে ব্যাখ্যা করার সমস্ত প্রচেষ্টাকেই উক্ত বক্তব্য খারিজ করে।
একজন ফুটপাথবাসীকে সলমন খান গাড়ির নীচে পিষে মারার পর বা দলিত গণহত্যার খুনিরা যখন ছাড়া পায়, তখন দেখা বলা হয়েছিল প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যদান অভিযুক্তকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ‘যথেষ্ট’ নয়, এটাও বলা হল ‘কাউকে’ দোষী হিসাবে সাব্যস্ত করতে কোনো ধরনের চাপ ছিল না। কিন্তু শ্রমিক ও ইউনিয়ন কর্মীদের অভিযুক্ত করার এরকম এক ঘটনায় কোনো একটি মৃত্যু খুন হিসাবে যদি প্রমাণিত না হয়, যদি খুনের জন্য ব্যবহৃত অস্ত্র বা খুনিদের প্রমাণ না মেলে, অার মামলায় বেশিরভাগ শুনানির ক্ষেত্রে যদি তাদের নিজস্ব সাক্ষী বা প্রমাণ না মেলে, তবে তাতে কি যায় অাসে?
প্রিকল শ্রমিক – তাঁদের দশ বছরের লড়াই
কোয়েম্বাত্তুর ইউনিটে বেশিরভাগ শ্রমিকরা ২০০৭ সালের গোড়ায় এ অাই সি সি টি ইউ অনুমোদিত দুটি ইউনিয়ন গঠন করেন। তখন কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে বা তাদের সঙ্গে অালাপ-অালোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করতে রাজি হয়নি। বরং এই বলে শ্রমিকদের হুমকি দেয় যে নতুন ইউনিয়নের সংসর্গ ত্যাগ না করলে তারা কোয়েম্বাত্তুর ছেড়ে চলে যাবে।
শ্রমিকদের লং-মার্চ – শ্রমিকদের নানান দাবিকে জনপ্রিয় করতে প্রিকলে শ্রমিকরা তামিলনাড়ুতে রাজ্যস্তরে দুটি লং-মার্চ করেন। মূল দাবিগুলো ছিল – ন্যূনতম মজুরি হিসাবে মাসিক ২০ হাজার টাকা, অাবাসনের অধিকার, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দান, এল এ বিল ৪৭/২০০৮ মারফৎ অ্যাপ্রেন্টিসদের অধিকার অার এ প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অবিলম্বে বিজ্ঞপ্তি জারি।
সর্বভারতীয় ধর্মঘট সংগঠিত করার ক্ষেত্রে প্রিকল শ্রমিকরা নেতৃত্বকারী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবি অাদায় করে – খুনের মামলা চাপিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকরা দৃঢ়ভাবে নিজেদের ঐক্য বজায় রাখেন। ফলে ২০১১ সালে কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়ে অালাপ-অালোচনা শুরু করে। ২০১২ ও ২০১৪ সালে কর্তৃপক্ষ দু-দুটো মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি করতে বাধ্য হয়, যার ফলে গ্রেড ৫-এ দীর্ঘ ২৫ বছর কর্মরত একজন শ্রমিক, যিনি ২০০৭ সালে (ইউনিয়ন স্বীকৃতি পাওয়ার অাগে) বেতন পেতেন ৮৫৯৩ টাকা, ২০১৫ সালে (ইউনিয়ন স্বীকৃতি পাওয়ার পর) বেতন পাবেন মোট ২৪,৪২৭ টাকা। ইউনিয়ন স্বীকৃতি পাওয়ার অাগে ২৫ বছর কর্মরত একজন শ্রমিক অানুষাঙ্গিক সুবিধা নিয়ে পেতেন ১.২৫ লাখ টাকা। অার ২০১৫ সালে (স্বীকৃতি পাওয়ার পর) পাচ্ছেন ৩.৫৫ লাখ টাকা।
অতীতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার বিষয়টা কর্তৃপক্ষ একতরফা ও যথেচ্ছভাবে চাপিয়ে দিত শ্রমিকদের ওপর। অার এখন গত দুটো চুক্তির সময়ে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির বিষয়টা যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে ঠিক হয়।
শ্রমশক্তি সংকোচনের বর্তমান সময়ে তাঁরা সফলতার সঙ্গে ২৩০ জন শ্রমিকের চাকরি নিশ্চিত করে, অার এমন ৫০০ জন শ্রমিকের বিষয়গুলো সমাধান করেন যারা কর্তৃপক্ষের কাছে ছিলেন নেহাতই অপরিচিত।
২০০৭ সালে প্রিকলের মহিলা শ্রমিকরা ধর্মঘটের সময়ে ১৭ ঘণ্টা ব্যাপী রাস্তা রোকো সংগঠিত করেন এবং একটা সময়ে কারখানাকে ঘেরাও করতে ও পুলিশী ব্যারিকেড ভাঙ্গতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে
ইউনিয়নকে ভাঙ্গার এবং শ্রমিকদের মনোবলে চিড় ধরাবার সমস্ত সম্ভাব্য কৌশল নেওয়া হয়েছিল। যেমন
-
১। পুলিশ মারফত শ্রমিকদের ওপর মিথ্যা মামলা চাপানো হয়।
২। শাস্তি হিসাবে কোম্পানি বেশ কয়েকজন ইউনিয়ন কর্মীকে উত্তরাখণ্ড ইউনিটে বদলি করে দেয়।
৩। ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হয়, মজুরি বৃদ্ধি থেকে তাঁদের নিয়মিত মজুরি ইনক্রিমেন্ট ও অন্যান্য সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৪। বেশ কিছু শ্রমিককে নামিয়ে দেওয়া হয় নীচুমানের কাজে।
৫। লক-অাউট করে দেওয়া হয় কোম্পানির একটা অংশ।
৬। বেশ কিছু শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়।
৭। কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জানায় যে যদি তাঁরা ঐ সমস্ত সংগ্রামী ইউনিয়নগুলোকে পরিত্যাগ করে তবে সব কিছুই তাঁরা ফিরে পাবেন, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।
তা সত্ত্বেও শ্রমিকরা প্রশাসন-কর্তৃপক্ষ-পুলিশ জোটের বিরুদ্ধে রাস্তায় ও অাদালত চত্বরের মধ্যে তাঁদের লড়াই জারি রাখেন এবং ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনার ভিত্তিতে তাঁরা কারখানার ভেতরে ও বাইরে সংগ্রাম বিস্তৃত করেন এতটাই তীব্রভাবে যে শিল্প-বিরোধ অাইনের ১০(১), ১০(৩) এবং ১০বি ধারা অনুযায়ী তামিলনাড়ু সরকার হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। এছাড়াও, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রিকলের শ্রমিকরা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে অনেকগুলো জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন।
কর্তৃপক্ষের সমস্ত কৌশল ও মিথ্যাচার ব্যর্থ হওয়ার পর পুলিশ ও প্রশাসন শ্রমিকদের দমাতে না পেরে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মতো অত্যন্ত গুরুতর ও মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে শ্রমিকদের জেলে ভরে দিল।
পুঁজিপতিরা প্রিকল শ্রমিক ইউনিয়নের মতো ইউনিয়ন দেখে ভীত কেন ?
প্রিকলের শ্রমিকরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীর যাবতীয় দাবি, এমনকি সামাজিক নানান বিষয় নিয়ে সোচ্চার হন। এ কারণে প্রিকল সংগ্রাম থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে শ্রীপেরমবুদুরের শ্রমিকরা (যাদের প্রায়শই মার্কিন অটোমোবাইল হাব ডেট্রয়ট-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়) তাঁদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করতে শুরু করেছেন। সর্বপ্রথম হুন্ডাই শ্রমিকরা প্রিকল শ্রমিকদের সাহসিকতার পথ ধরে এগোতে শুরু করেছেন। শ্রীপেরমবুদুরের অারও অনেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। তামিলনাড়ুতে শ্রমিক অান্দোলনে প্রিকল শ্রমিকরা তাঁদের নিজস্ব এক জায়গা করে নিয়েছেন।
শ্রমিকদের ওপর যথেচ্ছ মিথ্যা মামলা চাপানো ও কোর্টের অাদেশ সত্ত্বেও প্রিকল সংগ্রামের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, শ্রমিকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন অার ইউনিয়নটি দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়েছে।
রায় ঘোষণা হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর নতুন করে হামলা নামানোর তোড়জোড় শুরু করছে। প্রিকল শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের সংগ্রামের দশম বার্ষিকীর শুরুটা তাঁরা করবেন ৫ মার্চ ২০১৬, গোটা বছর জুড়ে উৎসব পালনের মাধ্যমে। এই উৎসবটি হবে ট্রেউ ইউনিয়ন স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেওয়া, শ্রম-কানুনকে লাগু করতে কোম্পানিকে বাধ্য করার উৎসব। এবং শেষবিচারে সংগ্রামে বিজয়লাভের উৎসব।
প্রিকল শ্রমিকদের ৮ জন নেতা কোয়েম্বাত্তুর জেলে রয়েছেন। এটা হল সেই একই জেলখানা, যেখানে চিন্নিয়ামপালায়ামের শহীদ শ্রমিকদের বন্দি করে পরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এটা হল সেই জেলখানা, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভি ও চিদম্বরাম বন্দি ছিলেন।
প্রিকলের শ্রমিকরা তাঁদের ৮ জন কমরেডের দ্রুত মুক্তির জন্য সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন, সংগ্রামের নায়ক হিসাবে যাঁরা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।
নিজেদের গভীর দুঃসময়ের মধ্যেও প্রিকল শ্রমিকরা দৃষ্টান্তমূলক হিম্মত ও সংহতির ছাপ রেখে অন্যান্যদের যন্ত্রণার পাশে দাঁড়িয়েছেন। জেলবন্দি শ্রমিক ও কমরেডদের পরিবারকে যে তাঁদের সাহায্য করতে হবে – কিন্তু সবার অাগে ভাবতে হবে অন্যদের কথা। রায় ঘোষণার পর, বেতন পাওয়ার প্রথম দিনে তাঁরা তামিলনাড়ু ও পুডুচেরির বন্যা দুর্গতদের সাহার্যার্থে ৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন। এর অাগে মারুতি মানেসর কারখানার জেলবন্দি শ্রমিক পরিবারদের সাহায্যার্থে তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। বিহারে বণ্যাত্রাণ এবং নেপালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ত্রাণ তহবিলও তাঁরা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন।
তার সাফল্য, সংগ্রামী চেতনা ও সামাজিক প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্য ইউনিয়নটি বিশেষভাবে তীব্র হামলার মুখে পড়ে। প্রিকল শ্রমিকদের দেখানো পথে অটোমোবাইল সেক্টরের অন্য শ্রমিকরা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিয়ন গঠন করে অধিকার অাদায়ের লড়াই শুরু করেছেন। কর্পোরেট ঘরানা মনে করছে যে, এই রায় এবার শ্রমিকদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে এবং অনুপ্রেরণার বদলে প্রিকলের জন্য তা হাজির করবে এক সতর্কবার্তা। কিন্তু এ সবই হচ্ছে হাওয়ায় তৈরি করা পুঁজিপতিদের অট্টালিকা, বাস্তবের জমিতে যার কোনো স্থান নেই।
প্রিকল শ্রমিকদের সংগ্রাম – এক অনুপ্রেরণা : প্রিকল শ্রমিকরা এখন কোয়েম্বাত্তুরে কন্ট্রাক্ট ও সাফাই শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত। তাঁরা গ্রামীণ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁরা ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে। তাঁরা এতটাই সচেতন হয়ে এই কাজ করছেন যে শর্তসাপেক্ষ জামিন পাওয়ার পর পুডুকোট্টাই জেলায় গ্রামীণ গরিবদের মধ্যে থাকতে শুরু করেন এবং তাঁদের সংগ্রামের বার্তা ও লক্ষ্য সম্পর্কে প্রচার সংগঠিত করেন। এক দশক ব্যাপী সংগ্রামের এই রাস্তায় জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে ১০০-র বেশি বিক্ষোভ সমাবেশ ও জনগণের বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁরা সংগঠিত করেছেন সংহতিমূলক অান্দোলন।
অামাদের অবশ্যই প্রিকল, কোয়েম্বাত্তুরের দৃঢ়চেতা কমরেডদের কাছ শিক্ষা নিয়ে তাঁদের বার্তা ও অভিজ্ঞতাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে গোটা দেশে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে।
তাঁদের এখন দরকার অামাদের সংহতি, সমর্থন ও সহযোগিতা – গোটা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সমর্থন তাঁদের প্রয়োজন। এই অাদেশনামার সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে, যা সারা দেশের শ্রমিক অান্দোলনে প্রভাব ফেলবে।
শিল্প গণতন্ত্রের লক্ষ্যে : কোয়েম্বাত্তুরের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে দেশের নানা প্রান্তে। কোয়েম্বাত্তুরের প্রিকলে জর্জের মৃত্যুর এক বছর অাগে বৃহত্তর নয়ডায় একই ঘটনা ঘটে, যেখানে ইটালীয় সংস্থা গ্রাজিঅানো ট্রান্সমিশনির স্থানীয় কর্তাব্যক্তি ছাঁটাই শ্রমিকদের একটি দল কর্তৃক অাক্রান্ত হয়ে মারা যান। এটা জানা যায় যে, গ্রাজিঅানোর ঘটনাটা তখনই ঘটে যখন কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা গুণ্ডাবাহিনী শ্রমিকদের বেদম পেটাতে শুরু করে, তাঁদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ কথা বলবে এই অজুহাতে ডেকে অানার পর। গোরখপুরে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। মানেসারের মারুতি প্ল্যান্টেও এরকমই ঘটনা ঘটেছিল। গুরগাঁও-এ কর্মী ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে অান্দোলন চলাকালীন কর্তৃপক্ষের বাউন্সাররা একজন শ্রমিককে খুন করে, যারা ইউনিয়ন গঠনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে তা সর্বাত্মক এক ধর্মঘটের পথে যায়। প্রায়শই পশ্চিমবাংলার চটকলগুলোতে মিল ম্যানেজারদের কেন্দ্র করে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর মালিক বিপুল পি এফ বকেয়া রেখেছে এবং চূড়ান্ত মধ্যযুগীয় ও স্বৈরাচারী কায়দায় শ্রম-কানুনকে লঙ্ঘন করে চলেছে।
সমস্ত ক্ষেত্র যেন একই সূতোয় গাঁথা – শিল্পে গণতন্ত্র না থাকা, শ্রম-কানুনের অাকছার লঙ্ঘন, ইউনিয়ন গঠন করার অধিকারকে পুরোপুরি অস্বীকার করা, শ্রমিকদের দুঃসহ কাজের ও বসবাসের পরিবেশ এবং বলিয়ে-কইয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের বার বার নামিয়ে অানা অত্যাচার ও শাস্তি প্রদান। কিন্তু এগুলোকে মেনে নেওয়ার বদলে সরকার ও সংবাদ মাধ্যম কর্পোরেটদের সুরে সুর মিলিয়ে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন অান্দোলনের নিন্দা ও শ্রমকে নিজের অঙ্গুলি হেলনে চালাবার স্বার্থে পুঁজির অারও অবাধ স্বাধীনতার ওকালতি করে।
অাসুন, অামরা প্রিকল শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াই :
প্রিকল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যে রায় দেওয়া হয়েছে তা অাদতে শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে পুঁজিপতি শক্তিগুলোর বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ। বিচার ব্যবস্থার এই রায় সমগ্র শ্রমিকশ্রেণী ও তাঁদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে সরাসরি অাঘাত। অামরা সমস্ত শ্রমিক, শান্তিকামী ও গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকদের কাছে অাহ্বান করছি – জেলবন্দি সাহসী প্রিকল কমরেডদের পাশে দাঁড়ান। এবং তাঁদের মুক্তির সংগ্রামে পুরোপুরি সহযোগিতা করুন।
এই লক্ষ্যে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে সমস্ত শ্রমিক, বন্ধুশক্তি, ইউনিয়ন ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সমর্থন অাদায়ের জন্য একটি সংহতিমূলক অভিযান শুরু হয়েছে, যার ভেতর দিয়ে জনগণকে সচেতন করা যাবে। অাপনাকেও এই প্রচারাভিযানে সামিল হওয়ার জন্য অাবেদন করছি, অাবেদন জানাচ্ছি অাপনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এই বার্তা নিয়ে যেতে।
সমস্ত সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের কাছে অামরা অাবেদন জানাচ্ছি, প্রিকল কমরেডদের কাছে সংহতিমূলক বার্তা পাঠাতে। অাপনি এই ই-মেল মারফত তা পাঠাতে পারেন – e-mail : pricolworkers@gmail.com
নিম্নলিখিত ঠিকানায়ও অাপনি ডাক মারফত অাপনার বার্তা পাঠাতে পারেন :
KOVAI MAAVATTA PRICOL THOZHILALARGAL OTRUMAI SANGAM,
126, ESWARAN KOIL VEEDHI,
OPP. PRICOL CO-OP STORES,
SRKV POST,
PERIANAICKEN PALAYAM,
COIMBATORE – 641020
INDIA
Blog : http://pricol-thefacts.blogspot.in/
প্রিকল শ্রমিকদের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে অাপনাকে মুক্ত হস্তে দান করার জন্যও অাবেদন করছি।
প্রিকলের অাটজনকে মুক্তি দাও ।
শ্রমিক অান্দোলনে নামিয়ে অানা হামলাকে প্রতিহত করুন।
প্রিকল শ্রমিকদের ন্যায় বিচারের স্বার্থে
এ অাই সি সি টি ইউ-র প্রচার অভিযানে সামিল হোন।