বামপন্থী বন্ধু, সমর্থক, দরদিদের প্রতি খোলা চিঠি

প্রিয় সাথী,

অাপনি, অামি, অামরা সকলেই এই মুহূর্তে এক বড় ধরনের রাজনৈতিক লড়াইয়ের অংশীদার। সকলেরই ইচ্ছা বিগত ৫ বছর ধরে যে প্রতারক, বিশ্বাসঘাতক সরকারটা চলল তাকে উচিত শিক্ষা কিভাবে দেওয়া যায়। বাংলার বুকে প্রতিদিন যেভাবে গণতন্ত্র অাক্রান্ত ও রক্তাক্ত হচ্ছে, জনগণের অধিকারগুলো যেভাবে বিপন্ন ও পদদলিত হচ্ছে, তাকে কিভাবে প্রতিহত করা যায় এবং গণতন্ত্র ও অধিকারকে রক্ষা করা যায়। এটি অামাদের সম্মিলিত ইচ্ছা। এ প্রশ্নে বোধহয় অামাদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। নিঃসন্দেহে বলা যায়, রাজ্যের সমাজসচেতন, শান্তিপ্রিয়, গণতন্ত্রপ্রিয় সমস্ত মানুষই অামাদের সাথে একমত হবেন। প্রতিদিন হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়নমুখী কাজ-কর্মের নামে যে তঞ্চকতা চলল, তার স্বরূপ মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা অামাদের অাশু কর্তব্য। ‘সততার প্রতীক’ যেভাবে ‘দুর্নীতির মডেল’ হয়ে উঠলেন, তাও মানুষ স্বচক্ষে দেখছেন।

কিন্তু জনগণের এই ইচ্ছা-অাকাঙ্খা ও অভিজ্ঞতার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে সিপিএম নেতৃত্ব এক বিপথগামী পথে পুনরায় যাত্রা শুরু করলেন। যুক্তি হিসাবে হাজির করলেন একরাশ কুযুক্তি : “অামরা দুর্বল, তাই একার পক্ষে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাজিত করা সম্ভব নয়”, “অামরা কোনো জোট বা অাঁতাত করছি না, অামরা একসাথে বসে অাসন বোঝাপড়া করছি”, যাতে “একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দেওয়া যায়” – ইত্যাদি। বলা হল, অতীত ভুলে যেতে হবে, বর্তমানটাই অাসল কথা। বর্তমানের প্রয়োজনে ‘গণতান্ত্রিক’ কংগ্রেস দলের সাথে অাসন বোঝাপড়া কোনো অন্যায় নয়, বরং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত। দলের প্রথম সারির নেতা ও রাজ্য সম্পাদক কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র জানালেন, এটা বুঝতে না পারা রাজনৈতিক সংকীর্ণতা। সূর্যবাবু দলের মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকায় (১৩ মার্চ ২০১৬) এক বিরাট মাপের নির্দেশাত্মক নিবন্ধ লিখলেন, কর্মী-সমর্থক-দরদিদের ‘সব বিভ্রান্তি’ কাটিয়ে তোলার চেষ্টা চালালেন। অতীতেও এ ধরনের ‘বিভ্রান্তি’ কাটানোর লক্ষ্যে নেতৃত্বের পক্ষ থেকে লেখা হয়েছিল, “শিল্পায়নই অাজকের যুগের শ্রেণীসংগ্রাম”। এসব কথায় অামরা পরে অাসব।

গোড়ার কথা দিয়ে শুরু করা যাক। ‘অতীত’কে ভুলে যেতে হবে, নতুবা এখন মনে না রাখলেও চলবে! এই ‘অতীত’ কত পুরনো? ৭০-৭২-৭৫ সালের কথা ভুলে যেতে বলছেন? অাচ্ছা ভোলা গেল! অারও একটু পেছনের অতীতে যদি যাই – ১৯৬৪ সালে তৎকালীন সিপিঅাই নেতৃত্ব (অাপনাদের ভাষায়, ডাঙ্গে-চক্র) যখন কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া খুঁজতে ব্যস্ত, তখন অাপনাদের নেতৃত্ব সিপিঅাই ভেঙে নতুন দল সিপিঅাই(এম) তৈরি করে কি ভুল করেছিল? তখন কি কদর্য, কদর্য শ্লোগান সিপিঅাই নেতৃত্ব বিশেষত ডাঙ্গে চক্রের বিরুদ্ধে দিয়েছিলেন, সে সবও না হয় ভুলে গেলাম। ‘কংগ্রেসী বন্ধুদের’ সঙ্গে ওঠা-বসা করতে করতে সিপিঅাই দলটার হাল কি হয়েছে, তাতো দেখতেই তো পাচ্ছেন। যাক, সেসব অতীতের কথা, অামরা সবাই প্রাণপণ চেষ্টায় সেসব ভুলেও গেলাম।

প্রগলভ কমরেড সূর্যবাবুর লেখাটা পড়ে হাসিটা চেপে রাখতে পারলাম না। অাপনাদের সাথে হাসিটা তাই ভাগ করে নিলাম। সূর্যবাবুর কথাটা হুবহু অাপনাদের কাছে তুলে ধরা যাক, “কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, কংগ্রেসের মধ্যে কি অাপনারা গণতান্ত্রিক শক্তি খুঁজছেন? শুধু কংগ্রেস কেন? অামি বলব, তৃণমূলের মধ্যে, বিজেপির মধ্যেও গণতান্ত্রিক শক্তি রয়েছে। এটা অামাদের ১৯৬৪ সালের বোঝাপড়া” (গণশক্তি, ঐ)। সূর্যবাবুর নিশ্চয়ই বোঝা উচিত এটা ১৯৬৪ সালের ‘বোঝাপড়া’ হতে পারে না, কেননা সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসও ছিল না, বিজেপিও ছিল না। একটা দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যক্তি বা শক্তি থাকলেই সে দলটা কি গণতান্ত্রিক দল হয়ে যায়? কি বলেন সূর্যবাবু? তবে কি কোনো একদিন ‘গণতান্ত্রিক’ বিজেপি ঠেকাতে ‘গণতান্ত্রিক’ তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে, বা কংগ্রেস ঠেকাতে বিজেপি-তৃণমূলের সাথেও অাপনারা অাসন বোঝাপড়ায় যাবেন? যাক সে কথা।

এভাবে গণতান্ত্রিক ব্যক্তি ও শক্তি খুঁজতে গেলে হিটলার, মুসোলিনীর দলেও বহু গণতান্ত্রিক ব্যক্তি/শক্তি খুঁজে পাবেন। রাশিয়ার বুকে স্টলিপিন প্রতিক্রিয়ার যুগে এভাবেই মেনশেভিকরা ‘কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রাট’ (সংবিধানপন্থী গণতন্ত্রী)-কে গণতান্ত্রিক অাখ্যা দিয়ে জোট গড়ায় কমরেড লেনিন মেনশেভিকদের সম্পর্কে কী বলেছিলেন একবার স্মরণ করে দেখুন। যদি স্মরণে না থাকে, তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের “কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস” (পৃঃ ৯৪-৯৫) একবার পড়ে নিতে পারেন। “ব্ল্যাক হান্ড্রেড” (কৃষ্ণ শতক) অত্যাচারের নৃশংসতার পরেও ঐ ধরনের ‘প্রতারক গণতন্ত্রীদের’ সাথে সংশ্রব না রাখার কথাই কমরেড লেনিন বারবার লিখে গেছেন, বলে গেছেন !!

ভারতের মতো কৃষিপ্রধান, পশ্চাদপদ পুঁজিবাদী সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রাক-বিপ্লব পরিস্থিতিতে কোনো রাজনৈতিক দল কৃষকদের জন্য কী নীতি গ্রহণ করছে, শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কী ভূমিকা পালন করেছে ও করছে, রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের অবস্থান কী – কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক বলে ঘোষণার অাগে এসব প্রশ্ন বিচার করার কোনো প্রয়োজন কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র ও তাঁর অন্যান্য নেতৃবর্গের বিচারে অাসলো না? ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা বা ৭০ দশকের গণহত্যা, ‘৮৪-র শিখদাঙ্গা, শাহবানু মামলা, বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনায় কংগ্রেসের ভূমিকা বা নিশ্চুপ থাকা কি ‘নিছক ব্যতিক্রম’? কী বলেন, কমরেড মিশ্র?

অামরা পুরনো কথা, অতীতের কথা বলে সূর্যবাবু ও তাঁর নেতৃস্থানীয় সহযোদ্ধাদের বিড়ম্বনায় ফেলব না। অারও বড় বিপদ সম্পর্কে বামপন্থী বন্ধুদের সজাগ হতে বলব। বড় বড় বুর্জোয়া সংবাদমাধ্যম ও তাদের তাত্ত্বিক মুখপাত্ররা লাগাতার একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, পশ্চিমবাংলায় “বামপন্থার দিন শেষ”। কমিউনিজম ও বামপন্থা পৃথিবী থেকেই উধাও হয়ে গেছে। পশ্চিমবাংলায় অবশিষ্ট যেটুকু অাছে তাকেও বিদায় দিতে হবে। অার একাজে বুদ্ধবাবুর পূর্বতন সরকার তাদের হাতিয়ার হয়েছিল। ওরা বোঝালেন, এখন নয়া অর্থনীতি-শিল্পনীতির যুগ, উন্নয়নের যুগ। অতো শ্রমিক-কৃষকের কথা ভাবলে চলবে না। উন্নয়নের প্রয়োজনে কৃষক-উচ্ছেদ চলতে পারে, শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নেওয়া যেতে পারে, শ্রম-কানুনকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে যখন-তখন শ্রমিক ছাঁটাই করা যায়, মজুরির জন্য কোনো দরকষাকষি করা চলবে না ইত্যাদি প্রভৃতি। বুদ্ধবাবুকে ‘ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডার’ বানিয়ে বামপন্থী নীতি-অাদর্শ ও রাজনীতি ধ্বংস করতে তারা লাগাতার প্ররোচনা দিয়ে গেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছিল সেই কুখ্যাত তত্ত্ব ‘শিল্পায়নই শ্রেণীসংগ্রাম’। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর বহু বামপন্থী কর্মী-সমর্থক মমতা ব্যানার্জীর মধ্যে ‘অাজকের বামপন্থা’ খুঁজে পেয়েছিলেন। কী ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি!

পরিবর্তনের সরকার এলো, মা-মাটি-মানুষের গল্প হল, কিন্তু ভালো চলছে না। একটা দুর্বৃত্তের দল কবে পড়ে যায় তার ঠিক নেই, শাসকশ্রেণীগুলো তাই ‘বিকল্পের সন্ধানে’ ব্যস্ত। বামপন্থীরা অাবার ‘সংশোধিত’ হয়ে ক্ষমতায় ফিরুক, অাবার শ্রেণী অান্দোলন-গণঅান্দোলন তীব্র হোক, এটাও শাসকশ্রেণীর অভিপ্রেত নয়। এখান থেকেই শাসকশ্রেণীর মনঃপূত বিকল্প : কংগ্রেস-সিপিএম/বামফ্রন্ট জোট। কত সহজে মেলামেশা চলছে – দীপা দাশমুন্সি কংগ্রেসের প্রার্থী মনোনীত হয়েই সিপিএমের জোনাল অফিসে পৌঁছে যান, সূর্যবাবু কংগ্রেসের ব্লক সভাপতির দেওয়া গাঁদা ফুলের মালা গলায় চড়িয়ে হাত ধরাধরি করে মিছিল করছেন, গৌতম দেব, অরুণাভ ঘোষরা একসঙ্গে জনসভা করছেন। নীচুতলায় ছবিটা অারও পরিষ্কার, একে অন্যের দেওয়াল লিখছেন, প্রচারপত্র বিলি করছেন, ভোট চাইছেন। কোনো এককালীন বিষয় নয়, কংগ্রেস-সিপিএমের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বের যাত্রা শুরু হল এরাজ্যে। বামপন্থাকে অারও গৃহপালিত (ডোমেস্টিকেট) করতে শাসকশ্রেণীর যে অভিলাষ, সংকটগ্রস্ত সিপিএম নেতৃত্ব সেই পাতা ফাঁদেই পা দিলেন। দল রক্ষার জন্য, ক্ষমতায় দ্রুত ফিরে অাসার জন্য অার দেরী করতে বা ভিন্ন পথে হাঁটতে তাঁরা রাজি নন। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া অার্থিক নীতির বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য ৬ পার্টির বামপন্থী ঐক্য ও বামপন্থী উদ্যোগকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে সংসদ-সর্বস্ব বামপন্থা কংগ্রেস-এনসিপি-অারজেডি-জেডি(ইউ) ইত্যাদি নিয়ে রামধনু জোট বানিয়ে এগুতে চায়, সবই জনগণের নামে। সালিমের কাছে অাত্মসমর্পণও ছিল ‘জনস্বার্থে’, কংগ্রেসের কাছে অাত্মসমর্পণও ‘জনস্বার্থ’। অাপনি নিশ্চয়ই সিপিএম নেতৃত্বের এই দেউলিয়া রাজনীতিকে সমর্থন করেন না। বাংলার বুকে লালঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে অাসুন অামরা বিকল্প পথে হাঁটি। বামপন্থী নীতি-অাদর্শ-মূল্যবোধ বিসর্জন দেবেন না। লালসেলাম।

পুনশ্চ : ইতিমধ্যে ‘জনগণের মতামত সংগ্রহ’ করে সিপিএম তথা বামফ্রন্টের ‘উন্নততম’ নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করা হয়েছে। অার ‘কমিউনিস্টরা যেহেতু নিজেদের মতামত গোপন করতে ঘৃণা করে ‘, তাই ইস্তাহার জানিয়েছে, বামফ্রন্ট ‘বিকল্প সরকার’ গঠনের লক্ষ্যে এই নির্বাচনী লড়াই-এ নেমেছে। বলাই বাহুল্য, সেই বিকল্প সরকারে ‘জাতীয়তাবাদী-গণতান্ত্রিক’ কংগ্রেস দলের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। ভাবী মুখ্যমন্ত্রী কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র ও ভাবী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাননীয় অধীর চৌধুরীর যৌথ নেতৃত্বে সে মন্ত্রীসভা ‘জনগণের স্বার্থ’ রক্ষায় শপথ গ্রহণ করবেন। কিছু অবুঝ মানুষ অহেতুক জানতে চাইছে, সেই সরকার কি মাননীয় অসীম দাশগুপ্তের ‘বিকল্প অর্থনীতি’ অনুসরণ করবে নাকি মাননীয় মনমোহন সিং-এর ‘অর্থনৈতিক দিশা’ অনুসরণ করবে? অামরা এবার ধরেই নিতে পারি, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-শালবনীতে বড় বড় শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। নয়াচর বা চৌরঙ্গীতে পরমাণু বিদ্যুৎ-চুল্লি বসানোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ম্যাডাম গান্ধীর সাথে কমরেড সীতারাম একসাথেই নারকেল ফাটাবেন! পাহাড়ে জনমুক্তি মোর্চার বন্ধুদের নিয়ে এবং জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনীর সেনানায়কদের সাথে বকেয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ সেরে ফেলা হবে। যেসব অাদিবাসী মানুষ ‘উন্নয়নে’ বাধা দেবে তাদের ইউএপিএ ও ‘দেশদ্রোহ অাইনে’ অাটক রাখা হবে। যেভাবে দিল্লীতে নরেন্দ্র ভাই ছাত্রদের অাটক করছে! অাবহাওয়া ভালো থাকলে, ট্র্যাপিজের খেলায় দক্ষ সুব্রত মুখার্জী ও তাঁর বন্ধু-বান্ধবরা এ ধরনের ‘জনমুখী’ কাজে নিশ্চয়ই সহযোগিতা করবেন। এমন সুন্দর সকালের জন্যই এত কসরৎ! বামপন্থী বন্ধুদের শুধু অনুরোধ করব, মনে রাখবেন বাংলার জনগণ কিন্তু কোনো মীরজাফরকে কোনোদিন সেলাম জানায়নি।

Back-to-previous-article
Top