গোটা ২০১৫ জুড়ে একের পর এক নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি অাবার বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করল। পশ্চিমবাংলা ও কেরলে নিজের খাতা খোলা এবং এই দুটি রাজ্যে ভোট শতাংশ চোখে পড়ার মতো দুই অঙ্কে অর্জন করার পাশাপাশি এই প্রথম তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ও সম্ভাবনাকে বিরাটভাবে বাড়িয়ে তুলল। ক্ষমতার মসনদে দু-বছর অাসীন হওয়ার পর প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে মোদি সরকার যখন দ্রুতগতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানো শুরু করেছে তখন অসম বিজয় বিজেপির মনোবলে বহু প্রতীক্ষিত উৎসাহ যোগাবে।
অসম ও কেরল, এই দুটো রাজ্যে কংগ্রেস বিরাটভাবে পরাজিত হয়েছে। যখন কেরল পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলের এক প্রতিষ্ঠিত প্রবণতাকে হাজির করেছে, সেই প্রেক্ষিতে এল ডি এফ-এর বিজয় সেই প্রবণতারই অঙ্গ। গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে অসম হাতছাড়া হওয়াটা কংগ্রেসকে সত্যিকারে ভালোই ধাক্কা দিয়েছে। কিছুদিন অাগে পর্যন্ত অসম রাজ্যে অাশু ক্ষমতায় চলে অাসাটা বিজেপি প্রত্যাশাই করতে পারত না, যদিও সেই সম্ভাবনা ছিল, অার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে অবলম্বন করে বিজেপি সর্বদাই ‘বিদেশী নাগরিক’-এর মতো সংবেদনশীল ইস্যুটিকে ধরে নিজের ফায়দা লোটার জন্য মুখিয়েই ছিল। অসমে কংগ্রেসের ভাঙ্গন এবং বেশ কিছু বিধায়ককে ভাঙ্গিয়ে তরুণ গগৈ-এর একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগী হেমন্ত বিশ্বশর্মার বিজেপিতে যোগদান এবং এজিপি-বিজেপি জোট অসম রাজ্যে বিজেপির সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করল।
এই সুযোগের ফসলকে দুহাতে তুলতে বড়ো সহ বিজেপি বেশ কয়েকটি ছোটখাটো উপজাতির কাছে পৌঁছে যায়, অার অপরদিকে সঙ্গী খুইয়ে কংগ্রেস নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হল একা, বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়ে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের এই বিপুল জয়ের ফলে বিজেপি এখন এক সুবিধাজনক অবস্থানে এসেছে যা গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার উপস্থিতিকেই অারও শক্তিশালী করবে। অার এস এস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী কাঠামোর মধ্যে অসমীয়া অাঞ্চলিকতাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করাটা উদ্বেগজনক এক রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে নিয়ে চলেছে অসম-এর মতো সংবেদনশীল ও বৈচিত্র্যময় জাতি-ধর্মভিত্তিক রাজ্যে নিজস্ব বিপজ্জনক বিভেদকামী এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবার অার এস এস-এর কোনো বাধা থাকল না।
দুটো রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই দলটি দাক্ষিণাত্যে স্রেফ কর্ণাটক ও হিমালয় রাজ্যগুলোর মধ্যে হিমাচল, উত্তরে উত্তরাখণ্ড, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মেঘালয় ও মিজোরাম-এ শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। অার, নিশ্চিতভাবেই বিজেপি সর্বভারতীয় স্তরে ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণীর প্রাধান্যকারী দল হিসাবে নিজের অবস্থানকে মজবুত করল। অসম ও কেরলের ধাক্কা কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের ও দিকনির্দেশের সংকটকে গভীরতর করল এমনই একটা সময়ে, যখন সে নিজেকে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মতো পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। নিজের ঘরকে ঠিক রাখতে কংগ্রেস বেশ কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হবে অার বিজেপি-বিরোধী শিবিরের অাঞ্চলিক পার্টিগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপকেও তাকে সইতে হবে।
কংগ্রেস ও বিজেপি ছাড়া, অাঞ্চলিক দলগুলো এবং সিপিঅাই(এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকেও এই নির্বাচনে অনেক কিছু বাজি রাখতে হয়েছিল। কর্তৃত্ববাদী ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ শাসন পরিচালনার ফলে ক্রমবর্ধমান মোহমুক্তি, রাজ্যে গভীর কৃষি ও শিল্প সংকট, চেন্নাই ও তামিলনাড়ুর উপকূল অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যাকে মোকাবিলা করার প্রশ্নে বিরাট প্রশাসনিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও তামিলনাড়ুতে এ অাই এ ডি এম কে নির্ধারক জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ডি এম কে-কংগ্রেস জোট তাদের অবস্থাকে উন্নত করলেও ক্ষমতার মসনদ থেকে এ অাই এ ডি এম কে-কে হটানোর ধারে-কাছেও অাসতে পারেনি।
তামিলনাড়ুতে, সিপিঅাই এবং সিপিঅাই(এম) পিপলস ওয়েলফেয়ার ফ্রন্ট নামে এক কর্মসূচীভিত্তিক বিকল্প বানাবার ধারণা নিয়ে সামনে অাসে। তাতে ভি এসকে এবং ভাইকোর এম ডি এম-কে রয়েছে, যারা কিছুদিন অাগে পর্যন্ত বিজেপির সঙ্গে ছিল। কিন্তু নির্বাচন যত এগিয়ে অাসতে থাকে, ততই তারা অভিনেতা বিজয়কান্তের নেতৃত্বাধীন ডি এম ডি কে এবং জি কে ভাসানের নেতৃত্বে কংগ্রেস থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে অাসা গ্রূপের মতো ধিক্কৃত শক্তিগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করে বসে। এই প্রক্রিয়ায়, বাম ও এমনকি পি ডব্লিউ এফ পেছনে চলে যায়, অার মঞ্চটাই বিজয়কান্তকে প্রত্যাশী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরার বাহনে রূপান্তরিত হয়। গোটা প্রচেষ্টাটা বিরাটভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, বিজয়কান্ত ভোটে তৃতীয় স্থানে চলে অাসে, অার তার দলের ভোট ৩ শতাংশেরও কম হয়।
সি পি অাই (এম)-এর কাছে কেরল ও পশ্চিমবাংলা ছিল বড় লড়াইয়ের ক্ষেত্র। কেরলে গোষ্টী দ্বন্দ্বে দীর্ণ সংগঠনটিকে দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধীপক্ষের ভূমিকায় সি পি অাই (এম) নামতে সক্ষম হয় এবং নব্বই-ঊর্ধ্ব ‘বিদ্রোহী’ জনপ্রিয় নেতা ভি এস অচ্যুতানন্দের নেতৃত্বে জোরালো প্রচারের সাহায্যে নির্ধারিত জয় হাসিল করে। অার কংগ্রেসের সম্ভাবনাকে পণ্ড করে দিল বিজেপি ব্লকের লক্ষ্যণীয় হারে ভোট বৃদ্ধি, যা নজিরবিহীনভাবে হয়ে দাঁড়াল ১৫ শতাংশ (তার জোট সঙ্গী ভারত ধৰ্ম সেনা পেয়েছে ৩.৯ শতাংশ ভোট)। ইয়েচুরি যতই অার এস এস-কংগ্রেসের অঘোষিত বোঝাপড়ার অভিযোগ অানুক না কেন, ঐ ভোট এসেছে কংগ্রেসকেই বিপদে ফেলে।
বহুদিন যাবত অার এস এস কেরলে বেশ সক্রিয় ও সংগঠিত হয়ে কাজ করছে। উত্তর কেরলে কান্নুর জেলায়, অারএসএস এবং সিপিঅাই(এম)-এর মধ্যে সংঘর্ষ এমনকি নির্মম হত্যাকাণ্ড সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায়শই ঘটে চলেছে। এই প্রথম বিজেপি তার ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে নির্বাচনী জয়ে রূপান্তরিত করল। কিন্তু একটা অাসনে জয় হলেও, বিজেপির ক্রমবর্ধমান প্রাপ্ত ভোটের হার রাজ্যে বিরাটভাবে অবহেলিত অাদিবাসী জনতার মধ্যে তাদের বেড়ে চলা প্রভাব (সোমালিয়ার সঙ্গে মোদির কেরলের তুলনা রাজ্যের অাদিবাসী অঞ্চলে বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে উঠে অাসে, যা অনেকেই ‘অপমান’ বলে গণ্য করে) এবং ভারত ধর্ম জন সেনার মতো বিজেপি জোট সঙ্গীর উত্থান চোখে পড়ার মতো। পরম্পরাগতভাবে কেরলের দ্বিমেরুকৃত রাজনীতিতে এখন নিশ্চিতভাবেই তৃতীয় শক্তির অাবির্ভাব ঘটল বিজেপির মাধ্যমে।
কেরলের থেকেও পশ্চিমবাংলা সি পি অাই (এম)-এর কাছে সামনে এল বৃহত্তম রণাঙ্গন হয়ে, অার বাংলার এই লড়াইয়ে সে পর্যুদস্ত হল পুরোপুরি। নির্বাচনী ফলাফল স্পষ্টতই দেখাচ্ছে যে, বামফ্রন্টের একদা সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি গ্রামবাংলায় সিপিঅাই(এম) এখনও তার শক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। রাজ্যে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে কংগ্রেসের সঙ্গে সুবিধাবাদী জোট অবমাননাকর বিপর্যয়ে পরিণত হল। সিপিঅাই(এম) এবং বামফ্রন্ট অাজ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৩২ অাসন পেল যা ২০১১-র প্রায় অর্ধেক। অার অপরদিকে সিপিঅাই(এম)-এর থেকে ভোট স্থানান্তরিত হয়ে শক্তিবৃদ্ধি ঘটিয়ে ৪৪টি অাসন দখল করে কংগ্রেস দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি হিসাবে অাত্মপ্রকাশ করল। ৩৪ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনপর্বের পরে ২০১১-র পরাজয় যদি সিপিঅাই(এম)-কে মারাত্মক চোট দিয়ে থাকে তবে এবারের বিপর্যয় সেই অাঘাতে যুক্ত করেছে প্রাণঘাতী অাবমাননা।
এপ্রিল ২০১৫-তে বিশাখাপত্তনমের কংগ্রেসে পার্টির গৃহীত রাজনৈতিক লাইনের অালোকে এই জোটকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে অক্ষম হয়ে সিপিঅাই(এম)-এর নেতারা বাংলার জোটকে নিছকই মানুষের ইচ্ছায় অাসন রফা বলে ব্যাখ্যা করেছেন। পশ্চিমবাংলায় সকলেই বোঝেন যে এর মধ্যে রাজনৈতিক সত্যতার লেশমাত্র নেই। নির্বাচনী জোট ও বোঝাপড়ার ফারাক নিছক কোনো নামকরণের মধ্যে নিহিত নেই। রাজ্যের বাইরের সিপিঅাই(এম)-এর পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা কংগ্রেসী নেতাদের সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন কি দিলেন না, তা দিয়েও বিষয়টা নির্ধারিত হয় না। এই সমন্বয়কে ‘মানুষের জোট’ হিসাবে বিজ্ঞাপিত করা হয়, রাজ্য জুড়ে যৌথভাবে প্রচার চলে এবং সিপিঅাই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক ও পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রকে জোট সরকারের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরা হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ভাগ বাটোয়ারা করে নিতে এই যে রাজনৈতিক তৎপরতা দেখানো হল তা কিন্তু তথাকথিত নির্বাচনোত্তর ‘বাধ্যবাধকতা’ থেকে উৎসারিত নয়, বরং সেটা ছিল সচেতন এক প্রাক নির্বাচনী ছক – নির্বাচনী প্রচারের সময়ে মঞ্চ ভাগাভাগির কূটনৈতিক চিত্রনাট্য থেকে অনেক বেশি।
এটা সকলেরই জানা যে কংগ্রেসের ভোট কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ, অার রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সিপিঅাই(এম) তার ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে ভরল অার সাবেক কংগ্রেসী ভোটাররা তৃণমূল অথবা নোটার দিকে ঝুঁকলো বেশিরভাগ অাসনে, যেখানে বামেদের প্রার্থী ছিল। কার্যত বহু অাসনে কংগ্রেসের প্রচার নির্ভর করেছিল সংগঠিত বাম ক্যাডারদের শক্তি ও কর্মতৎপরতার ওপর। বামেদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অাসনে কংগ্রেস ”বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা”র নামে প্রার্থী দিয়েছিল, সেগুলোর কথা না হয় উহ্যই থাকল।
নির্বাচনী পাটিগণিত অনুযায়ী অাশা ছিল যে কংগ্রেস-বাম জোট গোটা উত্তরবঙ্গে ঢালাও জিতবে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, উত্তরবঙ্গে অালিপুরদুয়ার, কুচবিহার, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা এবং পার্শ্ববর্তী মধ্যবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ৭৬টি অাসনের মধ্যে তৃণমূল ৩২টি অাসনে জিতেছে, জোটের জেতা ৩৮টি অাসন থেকে সামান্য কম। অার জোটের মধ্যে সিংহভাগ ২৮টি অাসন পেল কংগ্রেস, অার বামেদের জন্য পড়ে থাকল মাত্র ১০টি। ২০১৪-র নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, কংগ্রেস ২৯টি অাসনে এগিয়ে ছিল। কিন্তু এবার সিপিঅাই(এম)-এর সমর্থনে পুষ্ট হয়ে তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৪৪, অার বামফ্রন্টের মোট অাসন সংখ্যা ৩২-এ অাটকে থাকল, ২০১৪ সালের প্রায় সমান।
২০১১-র পরাজয়ের পর সিপিঅাই(এম) পশ্চিমবাংলায় শুদ্ধিকরণ অভিযান চালানোর কথাবার্তা বলেছিল। কিন্তু পার্টির যে সমস্ত বড় বড় ভুলের জন্য বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ গরিব ও কৃষক সমাজের, এমনকি প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সে ব্যাপারে অামরা কখনই কোনো অান্তরিক অাত্মসমালোচনা করতে দেখিনি। নির্বাচনী প্রচারের সময় সিপিঅাই(এম) সিঙ্গুর শিল্পায়নের দেউলিয়া ধরনটাকে তুলে ধরে, সিঙ্গুর থেকে শালবনি পর্যন্ত এক পদযাত্রা সংগঠিত করে — যে দুটোই জমি অধিগ্রহণের নিষ্ঠুর প্রতীক, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে জমি-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করেও স্থাপিত হল না কোনো শিল্প বা জুটল না কর্মসংস্থান। অার খোদ সিঙ্গুরে, সিপিঅাই(এম) প্রার্থী হলুদ রঙের ন্যানো গাড়িতে চড়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচার শুরু করলেন, ত্রুটিপূর্ণ ধারণা হিসাবে যে মডেলটিকে টাটা নিজেই বাতিল করেছেন।
অনুশীলনে একমাত্র যে ‘শুদ্ধিকরণ’টি চোখে পড়ে তা হল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠন করা, প্রভাবশালী অানন্দবাজার গ্রুপ যাকে বামেদের তরফ থেকে ‘বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী, বাস্তবসম্মত পুনরাবিষ্কার’ বলে উদ্বাহু প্রশংসা করে, এই অাঁতাতটির ওকালতি ও বাস্তবায়নের ভূমিকা নেয়, দীর্ঘস্থায়ী নির্বাচনী প্রচারে ঐ জোটের মুখপত্র হিসাবে কাজ করে। এখন এটাই দেখার যে সিপিঅাই(এম) কীভাবে বঙ্গবিপর্যয়ের বিষয়টি মূল্যায়ন করে, যা রীতিমতো অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। একগুঁয়ে মনোভাবের বশবর্তী হয়ে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়াটা অস্বীকার এবং সুবিধাবাদ কেন্দ্রিক সূত্রায়নই এই বিপর্যয়কে ডেকে অানে ও প্রধানতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিহারের ঐক্যবদ্ধ বাম ব্লকের লাইনে বাম ঐক্যকে অারও বিস্তৃত ও পুনরুজ্জীবিত করার বদলে সিপিঅাই(এম) তার পশ্চিমবাংলার নিজস্ব পুরনো মডেলটিকেও বিসর্জন দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য ‘গণতান্ত্রিক’ সহযোগী হিসাবে কংগ্রেসকেই অালিঙ্গন করে বসল। বিহারের উৎসাহজনক অভিজ্ঞতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে সিপিঅাই(এম) সেই ব্যাপকতম ঐক্যের লক্ষ্যে এগিয়ে গেল, যা বোধহয় বিহারে তার ‘হাতছাড়া’ হয়। অার অবিকল সেই ব্যাপকতম ঐক্য গড়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য পশ্চিমবাংলাকে ব্যবহার করা হল পরীক্ষাগার হিসাবে। যেখানে বিহারে ব্যাপকতম ঐক্য সফলতা পেল বিজেপি বিরোধী জোট হিসাবে, পশ্চিমবাংলায় তার মূল লক্ষ্য ছিল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এই বিপর্যয়কর পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুস্পষ্ট ফলাফল যা সকলের চোখের সামনে মেলে ধরল, তা হল – তৃণমূলের পাশাপাশি লাভবান হল কংগ্রেস ও বিজেপি। অার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল বামেরা, এই গোটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে তাকে চোকাতে হল রাজনৈতিক মূল্য।
অসম বিজয়কে তার সবচেয়ে ভালো পুরস্কার হিসাবে উদ্দীপ্ত বিজেপি মোদি সরকারের দ্বিতীয় বার্ষিকী উদযাপন করছে। তৃণমূলও পশ্চিমবাংলায় তার কর্তৃত্ববাদী জনমোহিনী শাসনের দ্বিতীয় দফা সূচনার পথে, তখন বামেদের শিক্ষা নিয়ে মজবুত করতে হবে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন রাজনৈতিক ভূমিকা, কর্পোরেট লুণ্ঠন ও সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে প্রতিরোধ করতে জনগণের সংগ্রামে সবচেয়ে অবিচল ও বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।