প্রিয় রাজ্যবাসী,
সে কী হৈ চৈ। সুদিন এলো বলে। টিভিতে-খবর বিক্রির কাগজে-বিজ্ঞাপনে শুধু একটাই কথা। নরেন্দ্র মোদী অাসছে, এবার সুদিন এলো বলে। খাদ্যদ্রব্য সহ সমস্ত জিনিসপত্রের দাম কমবে, বেকারদের চাকরি হবে, কালো টাকা ঊদ্ধার করে দেশবাসীর প্রত্যেকের নামে ব্যাঙ্কে ১৫ লক্ষ টাকা জমা পড়বে, দুর্নীতি প্রায় দূর হয়ে যাবে। অাসমুদ্রহিমাচল জনসভা করে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ এবং অার এস এস সরসংঘচালক মোহন ভাগবত এই কল্পকথা প্রচার করেছিল, অার তলায় তলায় কর্পোরেট পুঁজিপতি ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের অাশ্বস্ত করেছিল, তোমাদের লুঠ-পাটে কোনো বিঘ্ন হবে না, বরং জল-জমি-জঙ্গল ও প্রাকৃতিক সম্পদ গ্রাস করতে নমো ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সহায়তা-ই করবে। বিদেশ থেকে এফ ডি অাই অাসবে, অামেরিকার সাথে দোস্তি হবে। ব্যবসা অারও ফুলে-ফেঁপে উঠবে। অথচ গ্রাম-শহরের কর্মহীন মানুষের ১০০ দিনের কাজ সংকুচিত করতে এদের কোনো দ্বিধা হয় না।
৫ মাস যেতে না যেতেই সুদিনের গল্প শেষ ! এখন বলছে বিদেশ থেকে, সুইস ব্যাঙ্ক থেকে এক টাকাও ঊদ্ধার করা যাবে না। ওসব ভোটের সময় বলতে হয়, ভোট পাবার জন্য বলতে হয়, ভোট মিটে গেলে ভুলে যেতে হয়। এখন তাই নতুন কথা – স্বচ্ছ ভারত গড়ো। এ্যাডলফ হিটলারের ক্লিনজিং অপারেশনের ভারতীয় সংস্করণ। মোদি থেকে শুরু করে সংঘ পরিবারের চ্যালা-চামুণ্ডারা ঝাঁটা হাতে স্বচ্ছ ভারত গড়ার কাজে নেমে পড়েছে। সেলিব্রিটিরা সবাই এখন ঝাড়ু হাতে এই অভিযানে নেমেছে। কেউ যদি ভুল করে জিজ্ঞাসা করে বস্তিগুলোর নর্দমা পরিষ্কার কবে হবে, গরিব শ্রমজীবী জনগণের ভাঙাচোরা বাড়িগুলো কবে সংস্কার হবে, যারা খোলা অাকাশের নীচে বউ-বাচ্চা নিয়ে দিন কাটায় তাদের একটা মাথাগোঁজার ঠাঁই অার দু-মুঠো ভাতের ব্যবস্থা কবে হবে – তাহলেই হল। নিশ্চয়ই অাপনি বা অাপনারা দেশদ্রোহী! শিলাদিত্যের কথা মনে নেই? সার-বীজের দাম কবে কমবে একথা জিজ্ঞাসা করায় ওর হাজতবাস হয়েছিল। ভুলে গেলেন? এখন চলছে স্বচ্ছ ভারত গড়ার অভিযান!!
ন্যাংটার তো বাটপারের ভয় থাকে না। দেউলিয়া নরেন্দ্র মোদী অামেরিকা ঘুরে এলেন। যাবার অাগে জীবনদায়ী ওষুধের দাম কয়েক লক্ষ টাকা বাড়িয়ে গেলেন। ওখানে বলে অাসলেন তোমরা বড় বড় পুঁজিপতিরা ভারতে এসো। ব্যাঙ্ক-বীমা-প্রতিরক্ষা-রেলে তোমরা পুঁজি ঢালো। এফ ডি অাই এসো, এফ ডি অাই। অাজকের যুগে বিদেশ বলে কোনো কথা অাছে নাকি – গোটা পৃথিবীটাই অামেরিকার পুঁজিপতিদের ভাষায় গ্লোবাল ভিলেজ। ১৯০ বছরের ব্রিটিশ পরাধীনতার পর এবার মোদীর নেতৃত্বে মার্কিন দাসত্বের পালা শুরু হল বলে – সংঘ পরিবারের মীরজাফররা উঠে-পড়ে লেগেছে। এই দাসত্বের নতুন নাম – মেক ইন ইন্ডিয়া। এসো ভোগ কর, লুঠ কর এবং ভারত গড়ো! অামেরিকারন পুঁজিপতিদের কাছে ভাষণে নরেন্দ্র মোদী একথাই বলে এসেছেন।
পাঁচ মাস যেতে না যেতেই রাজা উলঙ্গ। কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন। শুরু হয়েছে ইসলামো ফোবিয়া (মুসলিম ভীতি-বৈরিতা)। কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিল ১৯৯১ সালে গ্রেট ব্রিটেনের একটি সংস্থা – রুনিমেড ট্রাস্ট। মুসলিম ভীতি-বৈরিতা তৈরির কাজে এরপর গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপ জুড়ে সব সরকার নেমে পড়ল। খাগড়াগড় বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে এই মুসলিম ভীতি-বৈরিতা ও বিদ্বেষ তৈরির কাজে নেমে পড়েছে সংঘ পরিবার, বিজেপি এবং অার এস এস-এর সেবকরা। একাজে ‘যোগ্য’ সঙ্গত দিচ্ছে সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলো। কে কত ‘নিখুঁত তথ্য ‘ দিতে পারে তা নিয়ে ওদের মধ্যে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। যারা সবার চোখের সমানে বাবরি মসজিদ ভাঙলো, দেশজুড়ে দাঙ্গা বাধালো, ২০০২ সালে গুজরাট জুড়ে মুসলিম গণহত্যা সংঘটিত করল, লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভের জন্য উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরে দাঙ্গার অাগুন জ্বালিয়ে দেশকে অাবার দ্বিখণ্ডিত করার লাগাতার চেষ্টা চালাচ্ছে, তারা হঠাৎ দেশপ্রেমিক সাজার চেষ্টা চালাচ্ছে। যাদের মুখপত্রে (সংঘ পরিবারের মুখপত্র কেশরীতে) প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, গান্ধীকে না মেরে নাথুরাম গডসের উচিত ছিল জওহরলাল নেহরুকে হত্যা করা। এরা নাকি শান্তিপ্রিয় দেশভক্ত, দেশমাতৃকার একনিষ্ঠ সেবক! এরাই খাপ পঞ্চায়েতের মাতব্বর মনোহরলাল খাট্টারকে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বানায়। বাবু, এদের দেশপ্রেম নিয়ে জোরে কইয়েন না, ঘুড়ায় হাসব!
৬৬ বছর ধরে লাগাতার চেষ্টা চালিয়েও এই বাংলায় বিজেপির কোনো ঠাঁই হয়নি। কিন্তু রাজ্যজুড়ে তৃণমূলী সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য, পরিবর্তনের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা, চরম দলতন্ত্র, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধে মানুষ বীতশ্রদ্ধ, বিক্ষুব্ধ। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে। যে কোনো ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে পায়ের তলায় জমি খুঁজতে চাইছে। লজ্জা ও ধিক্কারের বিষয়, কোনো কোনো ‘বামপন্থী’ দল ওদের প্রচারে গা ভাসিয়েছে। এমন সব বিবৃতি ও বয়ান দিচ্ছে যা সংঘ পরিবারের প্রচারকেই পুষ্ট করছে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণ হল, তিন জন মারা গেল, কয়েক জন অাহত হল। এরকম বোমা বিস্ফোরণ ও মৃত্যু এরাজ্যে অাকছার হচ্ছে, দিনদিন অারও বাড়ছে। যে কোনো শান্তিপ্রিয়, গণতান্ত্রিক মানুষ এর তীব্র নিন্দা করবে। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করবে। কেননা পুলিশ-প্রশাসনের তদন্তে মানুষের অাস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তদন্ত ও বিচারে যে বা যারাই দোষী প্রমাণিত হবে, তারা যে ধর্মেরই লোক হোক না কেন, সেই অপরাধীদের শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু বিচারবিভাগীয় তদন্তে বিজেপি খুশি নয়। তাতে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলা যাবে না, মুসলিম জনগণকে অাতঙ্কগ্রস্ত করা যাবে না, মাদ্রাসাগুলোকে টার্গেট বানানো যাবে না। তাই মোদী নিয়ন্ত্রিত নিয়া এবং এন এস জি-র তদন্ত শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে ২০১৫-র পৌর নির্বাচনে ও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করা। এই সংকীর্ণ স্বার্থ মেটাতেই সংখ্যালঘু জনগণকে হয়রানি করা, অাতঙ্কগ্রস্ত করা। শুরু হবে নিরীহ মুসলিম যুবকদের ওপর নজরদারি ও গ্রেপ্তারি।
যে কোনো মূল্যে অার এস এস-বিজেপির এই উৎপাত ও উন্মাদের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করতে হবে, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সন্ত্রাসের রাজনীতির বিরোধিতা করতে হবে। শ্রমজীবী জনগণের ঐক্য ও সম্প্রীতিকে রক্ষা করতে হবে। শ্রমিক-কৃষক ও মেহনতি মানুষের বেঁচে থাকার দাবিগুলো নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস কারোরই মাথাব্যথা নেই। বামপন্থীদের জনগণের গণতন্ত্র ও অধিকারের এই লড়াইকে জোরদার করতে হবে। এ বাংলাকে রক্তাক্ত করার সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ করতে হবে।
রুটি-রুজি-গণতন্ত্রের লড়াইকে শক্তিশালী করেই বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করুন।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতি ও সন্ত্রাসের রাজনীতিকে প্রতিহত করুন।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের গণতন্ত্র ও জীবন-জীবিকার ওপর হামলা প্রতিরোধ করুন।
সন্ত্রাস ও দাঙ্গার রাজনীতিকে পরাস্ত করুন।
বিপ্লবী অভিনন্দন সহ
সি পি অাই (এম এল) লিবারেশন
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি