সিপিএমের কলকাতা প্লেনাম : উত্তরগুলো অধরা

একটি নির্মম স্বীকারোক্তি ও একটি নির্ভেজাল সত্যকে দলিলে গুরুত্বসহ তুলে ধরার জন্য সিপিএমের বন্ধুদের ধন্যবাদ জানিয়ে কথা শুরু করা যাক। অামরা প্রথমে এই ‘স্বীকারোক্তি’ ও ‘নির্ভেজাল সত্য’ দলিলে যেভাবে অাছে, তা বাংলায় তর্জমা করে পাঠকের কাছে হাজির করব। দলিলটি হল, অতি সম্প্রতি (২৭-৩১ ডিসেম্বর ২০১৫) কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিপিএমের সাংগঠনিক প্লেনামে গৃহীত রিপোর্ট। দলিল শুরুতেই অামাদের জানিয়েছে : গণভিত্তি সম্পন্ন একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি কিভাবে গড়ে তোলা যায় তার উপর অালোচনা কেন্দ্রীভূত (ফোকাস) থাকবে। অর্থাৎ অামরা যা নিয়ে কথা বলছি তা একটি ‘বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির’ দলিল। তাই কমিউনিস্ট কর্মী ও সমর্থকরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব ও তার অনুশীলন-লব্ধ অভিজ্ঞতার অালোকে দলিলটিকে অালোচনা ও বিচার করবেন। এই অাশা করা যায়।

নির্মম স্বীকারোক্তিটি হল, “বামফ্রন্ট সরকারের গৃহীত নীতিগুলো নিয়ে যখন বিতর্ক উঠছে, সেই জটিল সন্ধিক্ষণে (ক্রুশিয়াল জাংচার) পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করতে অামরা অসমর্থ (? ব্যর্থ) হয়েছি । যদিও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বামেদের পরিচালিত সরকারের নীতি-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা হয়েছে এবং ১৮তম পার্টি কংগ্রেস ও ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে যথাক্রমে “কিছু পলিসি (নীতি) সংক্রান্ত বিষয়” ও “বর্তমান পরিস্থিতিতে বামেদের পরিচালিত সরকারের ভূমিকা” নিয়েও চর্চা হয়েছে।” কিন্তু “পার্টি কেন্দ্র ও পলিটব্যুরো” শক্তিশালী রাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বিষয়ে নিজে থেকে হস্তক্ষেপ না করে যুক্তরাষ্ট্রবাদী (ফেডেরাল) প্রবণতাকে সহায়তা করেছে, কেবলমাত্র যখন সংশ্লিষ্ট রাজ্য এ ধরনের কোনো বিষয় তুলতো তখন কেন্দ্র চর্চা করত” (১.১৪২ ধারা)। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে পরিচালিত পার্টি যে সমস্ত রোগে অাক্রান্ত – গোষ্ঠীবাদ, কেরিয়ারইজম (উচ্চাকাঙ্খা), যুক্তরাষ্ট্রবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা, অামলাতান্ত্রিক মনোভাব, যৌথ নেতৃত্বে পরিচালনাকে অগ্রাহ্য করা, নীচুতলা থেকে অাসা সমালোচনাকে উৎসাহিত করতে অপারগতা, গোষ্ঠীভিত্তিক ব্যক্তিকে দায়িত্বে নিয়ে অাসা, সমর্থন অাদায়ের জন্য কমরেডদের ভুলগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া, পার্টি কমিটির মধ্যে গোষ্ঠী বিভাজন ইত্যাদি বিষয় বিভিন্ন রাজ্যে লক্ষ্য করা যায়” – শীর্ষক অালোচনায় (১.১২২ ধারা), তাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ও স্বতন্ত্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রবাদ নিয়ে যে অালোচনা করা হয়েছে, দলিলের ১.১৪২ নং ধারায় তার নির্মম স্বীকারোক্তি : এই প্রবণতা বৃদ্ধিতে পার্টি কেন্দ্র ও পলিটব্যুরোও কম দায়ী নয়। কিন্তু নির্মম স্বীকারোক্তির মধ্যেও ভাবের ঘরে চুরি হয়ে গেল। বামফ্রন্ট সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের ফলে যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়-নেতাই নিয়ে অাপনাদের শক্তিশালী রাজ্য পশ্চিমবাংলা উত্তাল, কর্মীবাহিনী বিভ্রান্ত, সরকার টলোমলো, সেই দিনগুলোতে পার্টি কেন্দ্র ও পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটি কি অবস্থান নিয়েছিলেন বা যদি কোনো অবস্থান না নিয়ে থাকেন, তা তো স্পষ্ট ভাষায় দলিলে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। ‘বিপ্লবী’ কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো বা পার্টি কেন্দ্র এত বড় জটিল সন্ধিক্ষণে কোনো কার্যকরী ভূমিকা নিতে কেন ব্যর্থ হল, তার জবাব না দিয়ে এসব রোগ নির্মূল করবেন কিভাবে?

‘নির্মম স্বীকারোক্তি’ অারও হাস্যকর লাগছে যখন অাপনারা ‘নির্ভেজাল সত্য’টাকে ঐ একই দলিলে হাজির করেছেন : দলিলের তৃতীয় অংশে ‘শ্রেণী ও গণঅান্দোলনের নতুন দিক নির্দেশ’ নিয়ে অালোচনায় অাপনারা জানাচ্ছেন যে, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে বিশেষ “অধ্যয়ন গোষ্ঠী” (স্টাডি গ্রুপ) তৈরি করে শ্রেণীগুলোর ওপর নয়া উদারনৈতিক নীতিগুলোর প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা, অধ্যয়ন ও উন্নত ধারণা অাপনারা তৈরি করেছেন এবং তার ভিত্তিতে দলিলে নতুন প্রেক্ষাপটে জমি ও কৃষক ইস্যুগুলো নিয়ে কিভাবে এগুতে হবে, তার দিকনির্দেশ করেছেন। ঐ দিক নির্দেশের ৩.০৬ ধারায় নির্ভেজাল সত্যটাকে তুলে ধরেছেন। ৩.০৬ ধারার পূর্ববর্তী ধারা ৩.০৫-এ জমিদারতন্ত্র বিলোপ ও জমিদারদের হাতে থাকা সমস্ত জমি কৃষিশ্রমিক, গরিব কৃষক, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলি করার শ্লোগান রণনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করার সাথে সাথে জমির ইস্যুটি নতুন রূপ গ্রহণ করেছে বলে উল্লেখও করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৩.০৬ ধারায় লিখছেন, “… কর্পোরেট স্বার্থে জমিগ্রাস ও রাষ্ট্রের মদতে জমি অধিগ্রহণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে । কর্পোরেট ও রিয়েল এস্টেট হাঙরদের হাত থেকে কৃষকদের জমি রক্ষার প্রশ্ন জমি অান্দোলনের প্রধান বা মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কৃষকদের লড়াই, বিশেষত অাদিবাসী জনগণের লড়াই সামনে চলে এসেছে। গ্রামীণ দরিদ্রদের বসত জমির জন্য লড়াই জমি অান্দোলনের অার একটি দিক”।

ভারতবর্ষে “শিল্পায়ন ও উন্নয়নের” যে নয়া তত্ত্ব রং-বেরঙের বুর্জোয়া সরকারগুলো ফেরি করছে এবং তারই জন্য নাকি জমিগ্রাস ও জমি অধিগ্রহণ অনিবার্য বলছে, অাপনাদের বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে তা হলে কি করতে গিয়েছিল? যার মাশুল হিসাবে অাপনাদের ‘চোখের মণি’র মতো সরকার বিদায় পর্যন্ত নিল, তার থেকে বিন্দুমাত্র কোনো উপলব্ধি তো দলিলে দেখলাম না। শুধু অতীতের ভুল স্বীকার নয়, প্লেনামের পর মাসখানেকও যায়নি, সিঙ্গুর থেকে শালবনী যে বিশাল পদযাত্রা অাপনাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি সংগঠিত করল, তার সূচনায় সিঙ্গুরে বামফ্রন্টের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও দলের ‘মুখ’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো উদ্ধতভাবেই বললেন “ও পথেই হাঁটবো”। দলের রাজ্য সম্পাদক ও পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র তো বললেন, “ক্ষমতায় ফিরলে সিঙ্গুর মামলা তুলে নেবেন, ওখানে কারখানা হবে”। দলিলে লেখা হবে কর্পোরেট স্বার্থে জমি গ্রাস ও জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে কৃষকদের জমি রক্ষার লড়াই প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে এবং কৃষক সভার উচিত শোষিত জনগণের অন্যান্য ইস্যুগুলোর সাথে সাথে এই ইস্যুতে (যেহেতু গরিব জনগণকে সমাবেশিত করার কেন্দ্রীয় ইস্যু — জমি) শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ অান্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দলিল লেখার কালি এখনও শুকোয়নি, সরকার চলে যাওয়ার বেদনায় মন এখনও ভারাক্রান্ত, তথাপি কর্পোরেট স্বার্থে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের নীতি থেকে ‘বিপ্লবী’ কমিউনিস্ট পার্টি সরে অাসতে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্রবাদের এই নিকৃষ্টতম উদাহরণের পর পার্টি কেন্দ্র ও পার্টি পলিটব্যুরো কোন অবস্থান নিল, তা জানতে অামরা অাগ্রহী হয়ে থাকলাম। দলিল ও বাস্তব অনুশীলনের এই বৈপরীত্য সুবিধাবাদী বামপন্থার বৈশিষ্ট্য, বিপ্লবী বামপন্থার নয়। এই বৈপরীত্যের অসংখ্য উদাহরণ দলিলের ছত্রে ছত্রে দেখা যাবে। তা নিয়ে কিছু কথা অামরা বলব।

এবার অামরা ধীরে-সুস্থে প্লেনামের দলিলটাকে একটু বিচার করে দেখব। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনী ফলাফল পর্যালোচনার পর কেন্দ্রীয় কমিটি ৪টি বিষয়কে — (ক) পার্টির রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইন পুনঃপরীক্ষা করা, (খ) পার্টি সংগঠন ও জনগণের মধ্যে কাজের দিশা পর্যালোচনা, (গ) গণসংগঠনগুলো ও তাদের কাজের দিশা পর্যালোচনা এবং (ঘ) নয়া উদারনীতির ফলে অার্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও বিভিন্ন শ্রেণীগুলোর ওপর তার প্রভাব নিয়ে চর্চা এবং তার ভিত্তিতে নতুন নতুন শ্লোগানগুলোর সূত্রায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমোক্ত কাজটি যেহেতু ২১তম পার্টি কংগ্রেসে সেরে ফেলা হয়েছে, তাই বাকি তিনটি কাজ এই সাংগঠনিক প্লেনামে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই অারাব্ধ কাজকে সম্পন্ন করার জন্য ২৮৪টি ধারা বিশিষ্ট একটি বিরাট খসড়া রিপোর্ট ও তার সাথে বেশ কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান যুক্ত পরিশিষ্ট পর্যালোচনার জন্য পেশ করা হয়। পাঠকের সুবিধার্থে বলা যায় : (খ) প্রশ্নটির জন্য ১-২১৭টি ধারা, (গ) অংশের জন্য ২-২৫টি ধারা এবং (ঘ) অংশটির জন্য ৩-৪২টি ধারা দলিলে হাজির করা হয়েছে।
দলিল (১.৩) ধারা জানাচ্ছে, ১৯৬৪ সালে সিপিএম গঠনের পর “পার্টি সংগঠন সংক্রান্ত কর্তব্যকর্ম” নিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করে সংশোধনবাদীদের সাথে সম্পূর্ণ পার্থক্যরেখা টেনে দেওয়া হয় এবং একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ার দিশা গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৮ সালে ১০ম পার্টি কংগ্রেসে নতুন রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইন গ্রহণের পর ১৯৭৮-এর ডিসেম্বরে সালকিয়া প্লেনাম ও তার সিদ্ধান্ত সমূহ সর্বভারতীয় গণবিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলা এবং গোটা দেশে পার্টির বিস্তারের কাজ হাতে নেয়। সংশোধনবাদীদের সাথে সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা কতটা বজায় রাখা গেছে, তা নিয়ে নিশ্চিত পর্যালোচনা করা দরকার। কিন্তু তার অাগে “সর্বদাই সঠিক লাইন অনুসরণকারী” সিপিএমের সর্বশেষ কলকাতা প্লেনামের দলিল নিজেই স্বীকার করছে, “পার্টি সদস্যদের মান (কোয়ালিটি) অত্যন্ত নিম্নগামী হওয়ায় গণবিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার বিপরীতে বাস্তবে পার্টি একটি গণপার্টিতে পরিণত হয়েছে” (১.৭৫ ধারা)। কারণগুলো দলিলই তুলে ধরেছে :

(ক) ক্রমবর্ধমান সংসদবাদ, (খ) মতাদর্শগত অবক্ষয় ও তার ফলে অন্যান্য বুর্জোয়া পার্টির থেকে অালাদা থাকার মানসিকতার অভাব, (গ) পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির হয় দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ততা অথবা যুক্তরাষ্ট্রবাদ ও উদারতাবাদ (ঘ) পার্টি সদস্যদের মান নিম্নগামী হওয়ায় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতি অনুশীলনে বাধা (১.১৮ ধারা)। সংশোধনবাদীদের সাথে সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা বজায় রাখা দূরের কথা, দলিলে বলছে বুর্জোয়া পার্টিগুলোর সাথে পার্থক্য বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ নিশ্চয় অারও গভীরে।
দলিল তার ভূমিকায় স্বীকার করেছে ১৯৭৮ সালে সালকিয়া প্লেনাম যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন পার্টির ইমেজ ও প্রভাব ছিল ঊর্ধ্বমুখী, অার যখন বর্তমান প্লেনাম অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন পার্টির গণভিত্তিতে ক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে (১.১৫ ধারা)। এটা সত্যি কথা শুধু পশ্চিমবাংলাতেই ২০১০ সালে পার্টি সদস্যসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ১৯ হাজার ৪৩৫ জন, অার ২০১৫ সালে সদস্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ৭২ জন – অর্থাৎ ৭৩ হাজার ৩৬৩ জন পার্টি সদস্য হয় অন্য কোনো দলে চলে গেছে, নয় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে (পরিশিষ্ট ১)। ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টে সদস্যসংখ্যা কমেছে ২ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮৩৬ জন (২০১২) (পরিশিষ্ট ২), অার কৃষক ফ্রন্টে এই ক্ষয় মারাত্মক – কমেছে ৭১ লক্ষ ৯৪ হাজার ৫৩১ জন (২০১৪ হিসাবে) (পরিশিষ্ট ২)। যুব ফ্রন্টে এই ক্ষয় ৪৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ৭৯৭ (২০১৪ হিসাবে), ছাত্রফ্রন্টে এই ক্ষয় ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪৫৯ (২০১৩-১৪ হিসাবে) এবং মহিলা ফ্রন্টও ব্যতিক্রম নয় – এই ক্ষয় ২২ লক্ষ ৮৭ হাজার ১৭৩ জন (২০১৩-১৪ হিসাবে)। যে কোনো সমাজগবেষকের কাছে এই বিরাট ধ্বসের রাজনৈতিক-সামাজিক কারণ অনুসন্ধান করা এবং এরা গেলেন কোথায়, কার হাত শক্ত করলেন খুঁজে বার করা অত্যন্ত মূল্যবান কাজ। কিন্তু দলিল এই বিরাট ধ্বসের রাজনৈতিক-সামাজিক কারণগুলোকে সূত্রায়িত করে হাজির করতে পারেনি। তার থেকেও বড় প্রশ্ন, দলিল বলছে সালকিয়া প্লেনাম যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন পার্টির ইমেজ ও প্রভাব ছিল ঊর্ধ্বগামী। কলকাতা প্লেনামের সময় পার্টির ইমেজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে দলিল তা উল্লেখ করেনি। একটা ৩৪ বছরের চোখ ধাঁধানো সরকার পড়ে গেলে এরকম হয় নাকি? হয়, হয়, জানতি পার না!

পার্টির কর্মশৈলী অালোচনায় গণ লাইন অনুশীলনের ‘নতুন’ দিক নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। বলা হয়েছে, “পার্টির সমস্ত স্তরে কর্মশৈলীতে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার। রুটিন মাফিক কাজ, একঘেয়ে কাজের ধরন পার্টি সংগঠনের সমস্ত স্তরে জাঁকিয়ে বসেছে। তার মূল কারণ জনগণের সঙ্গে জীবন্ত যোগাযোগের অভাব” (১.১৭ ধারা)। সংশোধনবাদীদের কাজের ধরনের সঙ্গে এর পার্থক্যরেখা ঠিক কোথায়, অার কবে থেকে এই অ-বলশেভিক কাজের ধারা পার্টি রপ্ত করল এবং কেনই বা তার কোনো উত্তর দলিলে নেই। তবে যে বলা হত ‘জনগণের সঙ্গে জীবন্ত যোগাযোগ ও তাদের পাশে থাকার জন্যই অামরা পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর শাসন চালিয়েছি’ সেখানে কি অন্য পদ্ধতি অাসলে কাজ করেছে? সামাজিক ও রাজনৈতিক অাধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও দলতন্ত্র বিস্তার করার জন্য শাসন ক্ষমতাকে কাজে লাগানো হয়েছে? নাকি এই রোগ পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত অন্য রাজ্যগুলোতেই শুধু লক্ষ্য করা যাচ্ছে?

দলিলের (১.৪২) ধারায় রাজ্য কমিটিগুলোকে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, মার্কসবাদ-বিরোধী ও অ-মার্কসীয় মতাদর্শগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। কথাটা গোল গোল হয়ে গেল না কি? নন্দীগ্রামে কৃষকের “লাইফ হেল করে দেওয়ার” হুমকি কিংবা অহরহ অঙ্গীভঙ্গী করে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীকে অাকথা-কুকথা বলার বিরুদ্ধে রাজ্য পার্টি বা পলিটব্যুরো-কেন্দ্রীয় কমিটি কোন মার্কসবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা অামাদের জানা নেই। নির্ভেজাল এই সত্যকে দলিলই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতাবাদ, উদারতাবাদ, যুক্তরাষ্ট্রবাদ, সংসদবাদ ইত্যাদি বড় বড় রোগের পাশাপাশি কুসংস্কার, জাতপাত, পিতৃতান্ত্রিকতা, মহিলাদের প্রতি সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অাচার-অাচরণ ইত্যাদি সবই পার্টি মধ্যে বিদ্যমান। অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য কমিটি জানাচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে প্রগতিশীল মূল্যবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়, রাজস্থান রাজ্য কমিটি জানাচ্ছে পশ্চাদপদ সামাজিক মূল্যবোধ, ব্যয়বহুল বিবাহ অনুষ্ঠান, কুসংস্কার, জাতপাত, পিতৃতান্ত্রিক, সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি জানাচ্ছে, এই সমস্ত প্রবণতাগুলো বহাল থেকে যাচ্ছে, ধারাবাহিক শুদ্ধিকরণের পরও অাশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন রাজ্যের কমিটিগুলোর পাঠানো রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে পার্টি সদস্যদের সাথে সমাজের অন্যান্য মানুষের কোনো তফাৎই লক্ষ্য করা যায় না (১.১৬০ ধারা)। স্বীকার করা ভালো, দূর করা জরুরি। পার্টি সদস্যদের মধ্যে এই ধরনের অ-প্রগতিশীল, অ-মার্কসীয় ধ্যানধারণা বিস্তার করলে গণবিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার কাজ ব্যহত হবে তাই নয়, বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে দল ছাড়ার হিড়িকও পড়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপিতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক সংখ্যায় যোগদানের পেছনে এগুলোও কারণ কিনা খুঁজে দেখা দরকার ছিল। হিন্দিবলয়ে নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অগ্রাহ্য করে জাতপাতভিত্তিক দলগুলোকে ভোটদান বা ঐ সব দলে যোগদান অাকছার লক্ষ্য করা যায়। উত্তরপ্রদেশে সিপিঅাই-এর প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক মিত্রসেন যাদবদের বিএসপি-তে যোগদান বা বিহারে সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুবোধ রায়ের জেডিইউ-এ যোগদান এই দুই দলের সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা ক্রমাগত মুছে দিচ্ছে।

সাংগঠনিক এই সব সমস্যা ‘গণবিপ্লবী’ পার্টি কিভাবে কাটিয়ে তোলে তার প্রতি অামাদের অাগ্রহ থাকবে। দলিলের অন্য একটি ধারায় (১.৩৫) এসে থমকে যেতে হল। বলা হচ্ছে, হিন্দিবলয়ে, “বিহারে পার্টি স্থিতাবস্থায় দাঁড়িয়ে অাছে, উত্তরপ্রদেশে পার্টির অবস্থা নিম্নগামী। এই দুই রাজ্যে বড় বড় অাঞ্চলিক দলগুলোর সাথে নির্বাচনী অাঁতাত পার্টির স্বাধীন বিকাশ ভালোমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে” (১.৩৫ ধারা)। বহুদিন ধরে সিপিঅাই এই অনুশীলন করার পর ১৯৯৬ সালে কংগ্রেস সমর্থিত দেবেগৌড়া পরিচালিত যুক্তফ্রন্ট সরকারে অংশগ্রহণও করেছিল (ঐতিহাসিক ভুলের দিনগুলোতে)। কিন্তু ইতিহাসটা অার একটু পুরনো। ১৯৬৪-র বিভাজনের পর ১৯৬৭ সালে সিপিঅাই কয়েকটি রাজ্যে অকংগ্রেসী সরকারে অংশগ্রহণ করে এবং পরবর্তীকালে কেরালায় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত সরকারে অংশগ্রহণও করে। ১৯৭০-এ কেরালায় সিপিঅাই, অারএসপি, পিএসপি, মুসলিম লীগ যৌথভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে অচ্যুতা মেনন মন্ত্রীসভাও গঠন করে, ১৯৭১-এ অচ্যুতা মেনন মন্ত্রীসভায় কংগ্রেসও যুক্ত হয়। একইভাবে ১৯৭৮-এ কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সিপিঅাই-এর বাসুদেবন নায়ারও মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। কংগ্রেসের সাথে সিপিঅাই-এর এই দোস্তিকে সিপিএম কিভাবে ব্যাখ্যা করেছিল, তা নিশ্চয় সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্ব ভুলে যাননি। কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারকেও তারা বিভিন্ন সময় সমর্থন করে। এরই পরিণতি ছিল জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে সমর্থন। জরুরি অবস্থার সমর্থক হিসাবে পরিচিতি সিপিঅাই অাজও মুছে ফেলতে পারেনি। ‘প্রগতিশীল’ কংগ্রেসীদের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারে সিপিঅাই-এর অংশগ্রহণকেও সিপিঅাই তাত্ত্বিকরা “জাতীয় গণতন্ত্রের” লাইনের বিজয় বলেই তুলে ধরেছেন।

সিপিএমের ২১তম পার্টি কংগ্রেসের দলিল, বিশেষত রাজনৈতিক-কৌশলগত লাইনের পুনঃপরীক্ষার রিপোর্ট এবং কলকাতা প্লেনামে পেশ করা রিপোর্টে বাম-গণতান্ত্রিক অাঁতাত, জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, এমনকি ‘সমাজতান্ত্রিক ভিশান’ তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার কথা বলা হচ্ছে। তাহলে কোন লাইনের ভিত্তিতে বুদ্ধবাবু-সূর্যবাবুরা কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়া বা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অাঁতাতের গল্প ফেরি করছেন? কংগ্রেস কোন দিকে, কংগ্রেস কোন দিকে বলে বুদ্ধবাবু যে রণধ্বনি দিলেন, তা তো সিপিঅাই-এর অচ্যুতা মেনন, বাসুদেবন নায়াররা বহুদিন অাগেই দিয়েছেন। এটাই হওয়ার কথা ছিল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলের মতো বৃহৎ বুর্জোয়া-জমিদারদের দলের সঙ্গে যদি ন্যূনতম কর্মসূচীভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলা যায়, তবে রাজ্যস্তরে কংগ্রেসের সাথে ন্যূনতম কর্মসূচীভিত্তিক ঐক্যও গড়ে তোলা সম্ভব! পার্টি দলিলে যাই লেখা থাকুক না কেন যুক্তরাষ্ট্রবাদ অাজ এই পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে। পার্টি প্লেনাম যুক্তরাষ্ট্রবাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রামেরই অাহ্বান দিক না কেন, ক্ষমতাকেন্দ্রিক বামপন্থা এই বৃত্তের বাইরে অাসতে অক্ষম। দুই লাইনের সংগ্রাম তাই জারি থাকবে। সংগ্রামী বামপন্থী কর্মী-সমর্থককে একমাত্র বিপ্লবী বামপন্থার দিকেই এগুতে হবে। এছাড়া ভিন্ন পথ নেই।

Back-to-previous-article
Top