নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দু-বছর পেরিয়ে গেল। এই দু-বছরে তিনি এমন এক প্রশাসনিক পথে দেশকে নিয়ে গেছেন যা অামাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে বলতে গেলে এক রাজনৈতিক বিপর্যয় হয়েই দেখা দিয়েছে। জনগণের দুর্দশার প্রতি এমন নির্মম ও নির্লিপ্ত সরকার ভারত অাগে অার দেখেনি। দেশের এক বড় অংশ যখন খরা ও দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে টলমল করছে এবং প্রতিদিনই বহুসংখ্যক কৃষক ঋণ ও নিরাপত্তাহীনতার ভারে পিষ্ট হয়ে অাত্মহত্যার পথে যেতে বাধ্য হচ্ছেন সরকার তখন ঐ দুর্দশার প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে নিজের পিঠ চাপড়ে বলছে যে, কৃষি অায়কে বাড়িয়ে ২০২২ সালের মধ্যে তারা দ্বিগুণ করবে। সবচেয়ে খরাক্লিষ্ট রাজ্য মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের দুর্দশার প্রতি চরম নিষ্পৃহ থাকছেন, অার যারা ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে অস্বীকার করছে তাদের রাজ্য থেকে নির্বাসনের হুমকি দিচ্ছেন। তার মন্ত্রীসভার এক সদস্যা খরা কবলিত অঞ্চলগুলোতে তার সফরকে স্মরণীয় করে রাখতে নিজের স্মার্টফোনে নিজস্বী (সেলফি) তুলে যাচ্ছেন! প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ব্যস্ত থাকছেন বিদেশ সফর, নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা দিতে, কখনও সখনও সময় বার করে তার বেতার বাণী বিলোচ্ছেন বা মাদাম তুসোর সংগ্রহশালায় নিজের মোম মূর্তির তারিফ করছেন।
প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩১ শতাংশ পেয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু প্রায় প্রথম দিন থেকেই নাগরিকদের বড় অংশের বিরুদ্ধেই যেন স্থায়ী যুদ্ধে রত রয়েছে, যে নাগরিকদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন যারা ভোট দিয়ে এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিলেন। এই সরকারের জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ সবার কাছেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এ সত্ত্বেও সে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রতিভূ ২০১৩-র অাইনের বেপরোয়া লঙ্খনের মধ্যে দিয়ে ব্যাপক পরিমাণ কৃষি-জমিকে অ-কৃষি কাজে লাগাতে ও অধিগ্রহণ করতে সক্রিয় উদ্যোগ নিচ্ছে।
তার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সে দেশের অাইন ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তর্ঘাত হানছে – শ্রমিকের অধিকার, পরিবেশের সুরক্ষা-বন্দোবস্ত, প্রাকৃতিক সম্পদ, গণতন্ত্রের গোটা কাঠামো, সবকিছুই বিদেশী বিনিয়োগের বেদীমূলে বন্ধক দেওয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সেগুলোর প্রভাবশালী উচ্চপদে এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোতে অার এস এস ক্যাডারদের বসানো হচ্ছে। নির্বাচিত অ-বিজেপি সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হচ্ছে, অার বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে প্রশাসন হয়ে উঠেছে রাজ্যের মদতপুষ্ট নৈরাজ্য, সন্ত্রাস এবং নিরবচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রতীক।
জনগণের এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের সাথেই অাসছে ইতিহাসের উপর সংঘ বাহিনীর দূরভিসন্ধিমূলক হামলা। ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’-এর শ্লোগান দিয়ে মোদী ক্ষমতায় অাসেন। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে তিনি যেমন কেন্দ্রের মনমোহন সিং সরকার এবং রাজ্যগুলোতে অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচারাভিযান চালাচ্ছেন, তেমনি এমন এক অাখ্যান তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছেন যা দিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কংগ্রেসের রাশ টেনে ধরা যাবে এবং বিজেপির এমন একটা অতীত নির্মাণ করা যাবে যে অতীত বিজেপির ছিল না। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রথম যে কংগ্রেস নেতাকে তিনি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি হলেন প্যাটেল এবং শাসন ক্ষমতায় তার প্রথম বছরে মোদী তার ঢক্কানিনাদিত ‘স্বচ্ছ ভারত’ প্রচারের মধ্যে দিয়ে গান্ধীকে অাত্মসাৎ করে নেওয়ারও যথাসাধ্য চেষ্টা চালালেন। নেতাজি ফাইলগুলোকে প্রকাশ করে দিয়ে এবং অাম্বেদকরের ১২৫তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের মধ্যে দিয়ে সংঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠান এখন সুভাষ বোস এবং অাম্বেদকরের উত্তরাধিকারকেও হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সংঘ তাত্ত্বিকরা অামাদের বিশ্বাস করতে বলেন যে, অাম্বেদকর ‘জাতিভেদ প্রথাকে নির্মূল করা’র যে অাহ্বান জানিয়েছিলেন তার লক্ষ্য ছিল এক সম্প্রদায় হিসাবে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং অার এস এস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ অাম্বেদকরকে এক ‘মহান ঐক্যকারী’ বলে বর্ণনা করছে। অতএব, রোহিত ভেমুলা ও তার কমরেডদের যে ‘দেশদ্রোহী’ বলে ছাপ মারা হয়েছে এবং যে সমস্ত অান্দোলনের কর্মী ও বুদ্ধিজীবী ভগৎ সিং ও অাম্বেদকরের চিন্তাধারার প্রচার করছেন তাদের যে সংঘ বাহিনীর গুণ্ডাদের হাতে ভয়াবহ অাক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংঘের যুদ্ধ অভিযান অবশ্য বিভিন্ন স্তরে শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। তীব্র লড়াই করে কৃষকরা জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করেছেন। শ্রম-অাইন সংস্কারের উদ্যোগকেও রুখে দিতে শ্রমিকরা সফল হয়েছেন। পি এফ-এর টাকা তোলার উপর কর বসানোর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিবাদ সরকারকে তা প্রত্যাহারে বাধ্য করেছে অার সদ্য সদ্য শ্রমিকদের জঙ্গী প্রতিবাদ – যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বেঙ্গালুরুতে পোষাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলা শ্রমিকদের প্রতিরোধ – পি এফ থেকে টাকা তোলার পরিমাণকে সীমিত করার প্রশ্নে সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছে। গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি ও মহম্মদ ইখলাকের হত্যার পর খ্যাতনামা লেখক, শিল্পী, বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ঢল নামে তা ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং সংঘ বাহিনীর গুণ্ডাদের প্রতি মদত ও শাস্তি থেকে তাদের অব্যাহতি দানের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জনগণের দৃঢ় প্রতিবাদে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে। অার রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা এবং তারপর জে এন ইউ-তে ডাইনি-খোঁজা চালানো, এবং পুলিশী দমনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রতিবাদ বস্তুত ছাত্র-যুবদের অভ্যুত্থানের রূপে ফেটে পড়ে। মোদী রাজের বিরুদ্ধে জনগণের মোহভঙ্গ এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ নির্বাচনী ফলাফলেও দেখা যায় এবং এখন অাবার উত্তরাখণ্ডে রাষ্ট্রপতি শাসনের সিদ্ধান্তকে উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট নাকচ করায় মোদী রাজের বিরুদ্ধে বিচারবিভাগীয় ভর্ৎসনাও প্রত্যক্ষ করা গেল।
২০১৬-র মে দিবস শ্রমজীবী জনগণের কাছে অাহ্বান জানাচ্ছে – গণতন্ত্রের জন্য চলমান লড়াইকে সর্বশক্তি দিয়ে শক্তিশালী করুন। শ্রমিকশ্রেণী যেমন শ্রমিকদের অধিকারকে খর্ব করা এবং তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ও পেনশন থেকে বঞ্চিত করার মোদী সরকারের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করবেন, তেমনি মে দিবসের চেতনা শ্রমিকশ্রেণীকে লড়াকু জনগণের প্রতিটি অংশের সাথে হাত মিলিয়ে গণতন্ত্রের অভিন্ন এজেন্ডার ভিত্তিতে প্রতিরোধের এক বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তুলতেও উদ্বুদ্ধ করবে। দেখা যাচ্ছে, সংঘ বাহিনী জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বিপথগামী করে তুলতে এবং নিজেদের ফ্যাসিবাদী অভিযানে ও মেকি জাতীয়তাবাদী এজেন্ডায় জনগণকে কামানের খোরাক করে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অার তাই জনগণের ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সংহতির সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দুর্গ হিসাবে, জনগণতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা দৃঢ় প্রবক্তা হিসাবে, ভারতীয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কর্পোরেট-বিরোধী স্বার্থের একনিষ্ঠ প্রবক্তা হিসাবে অাত্মঘোষণা করাটাও শ্রমিকশ্রেণীর কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। প্রতিরোধ কর ভারত, প্রতিরোধ কর!